আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার নেশা কি?’ আমি বারবার বলবো, ‘ট্রাভেলিং, ট্রাভেলিং এবং ট্রাভেলিং’। আমি সারাক্ষণ ট্রাভেল করার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকি। এই প্রবণতা থেকেই বাংলাদেশ এবং ইন্ডিয়ার বেশ কয়েকটি জেলা ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার এবং সেসব জেলার সামাজিকতার ভিন্নতা সম্পর্কে জানতে পেরেছি ।
ভ্রমণপিয়াসী একজন মানুষ হিসেবে আমার সুযোগ হয়েছিলো নতুন একটা সুন্দর অভিজ্ঞতা অর্জনের।
রাঙ্গামাটি, বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। রাঙ্গামাটি মূলত উপজাতিদের বসতভূমি, যাদের আছে নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এবং খাদ্যাভাস।
সৌভাগ্যবশত তাদের এই খাদ্যাভ্যাস এবং সংস্কৃতি কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার।
২০১৭ সালে আমার এক কাছের বন্ধু যার দেশের বাড়ি রাঙ্গামাটি, আমাকে এবং আমার হাজবেন্ডকে নিমন্ত্রণ করেছিল তার এলাকাটি কাছ থেকে দেখার জন্য। তার পরিবার এবং তার অতিথি-পরায়ণতা এবং আন্তরিকতা অল্প কথায় বলে শেষ করবার নয়। সব খাবারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিন লেগেছিলো উপজাতীয়দের ঘরে তৈরি এক ধরনের পানীয়, যার নাম ‘দোচোয়ানি’। এই পানীয়ের রঙটা সাদা ধরনের, স্বাদ ঝাঁঝালো এবং গন্ধটা কড়া। এটি তৈরির মূল উপাদান হচ্ছে সাদা ভাত। ভাত পঁচিয়ে বিশেষ এক পদ্ধতিতে এটি প্রস্তুত করা হয়। আমাদেরকে এটি সন্ধ্যার নাস্তা হিসেবে পরিবেশন করা হয়েছিল সিদ্ধ বাঁধাকপি এবং কাঁচা শসার সাথে। সবচেয়ে অবাক লেগেছে যে বিষয়টি তা হলো, নারী-পুরুষ সর্বজনস্বীকৃত এই পানীয় ছাড়া তাদের কোন উৎসবে পরিপূর্ণতা পায় না।
আরেকটি খাবারের কথা না বললেই নয়, এই অঞ্চলের স্থানীয় একটি সমৃদ্ধ এবং স্বাস্থ্যকর খাবার হচ্ছে ‘ব্যাম্বু-চিকেন’। লোভনীয় এই খাবারটি ঐতিহ্যগতভাবে আদিবাসীদের কাছে পরিচিত ‘হুরোচুমা’ নামে। এর অনন্য স্বাদ এবং গন্ধের জন্য এটি শুধু পার্বত্য এলাকাতেই নয়, বরং সারা বাংলাদেশে পরিচিত। মাঝারি আকারের বাঁশের অংশের ভিতর মসলাসহ মুরগি দিয়ে কাঠ কয়লার চুলায় রান্না করা হয়। এটি একটি তেলমুক্ত এবং পুষ্টিকর খাবার। ঠিক এই একই রন্ধনপ্রণালীতে বাঁশের চোঙ্গার ভিতর শুটকি এবং তাজা মাছও রান্না করা হয়। ঐতিহ্যবাহী এই খাবারটি রাতের খাবার হিসাবে সাদা ভাত এবং রুটির সাথে আমাদেরকে পরিবেশন করা হয়েছিলো।
অতিথি আপ্যায়নে সেরা রাঙ্গামাটির সরল আর সহজ মানুষগুলো তাদের ঐতিহ্যকে সেই রাতে আমাদের সাথে ভাগাভাগি করেছিলেন খোলা আকাশের নিচে, যার সাক্ষী হয়ে ছিলো হাজারো তারা এবং চাঁদ। দুর্গম এলাকায় কাটানো সেই রাতটি ছিলো আমার জীবনের স্মরণীয় রাতের মধ্যে অন্যতম। সেরকম আর একটা মুহূর্ত কাটানোর সুযোগ যদি আবার পাই, সেটি আমি কখনোই ছাড়বো না।