রাস্তার ধারের দোকানগুলোতে লাল কাপড়ে মোড়া হাড়ি দেখতে পেলে প্রথমেই কোন জিনিস টা মনে আসে? বাহ! আপনার মনের কথা আমার সাথে মিলে গেলো যে! ‘বিরিয়ানি’ কথাটা মনে বা মগজে যেখানেই আসুক তা খেতে ইচ্ছা করবে না এমন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর। বিয়েবাড়ি কিংবা আনন্দের যেকোন অবকাশে খাবার পাতে জায়গা করে নেয় এই ঐতিহ্যবাহী খাবারটি। হরেক রকম বিরিয়ানি পাওয়া গেলেও ‘কাচ্চি বিরিয়ানি’ যেন ভোজনরসিকদের মনে যোগ করে অতিরিক্ত আনন্দ।
বিরিয়ানি মূলত দুই রকমের হয়ে থাকে। একটা ‘কচ্চি আর একটা ‘পাক্কি’। হ্যা, ঠিকই ধরেছেন, কাঁচা আর পাকা। উর্দূ শব্দ থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে।
এর কারণ হলো, কাচ্চি বিরিয়ানিতে কাঁচা মাংসের সাথে সুগন্ধি চাল ও হরেক রকম মসলা মিশিয়ে একসাথে রান্না করা হয় আর পাক্কিতে মাংসটা আগে থেকে রান্না করে নেওয়া হয়। তারমানে যেটা দাঁড়ালো যে, কাঁচা মাংসের ব্যবহারের কারণে এ বিরিয়ানির নাম কাচ্চি বিরিয়ানি।
ইতিহাসে বিরিয়ানির আগমন নিয়ে রয়েছে নানান রকম গল্প তবে ভারতীয় উপমহাদেশে বিরিয়ানি নামটা মুঘলদের হাত ধরে এসেছে বলেই সর্বজনখ্যাত। বলা হয়ে থাকে, সম্রাট শাহজাহানের বেগম মমতাজমহল একবার ব্যারাকে যেয়ে সৈন্যদের স্বাস্থ্যের খুব খারাপ অবস্থা দেখেন। তখনই তিনি বাবুর্চিকে নির্দেশ দেন এমন কিছু তৈরি করতে যা সৈন্যদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হওয়ার পাশাপাশি দ্রুত রান্না করা সম্ভব। এমনই চিন্তা থেকে মাংস, চাল আর মসলা একবারে বসিয়ে দম দিয়ে রান্না করা হয়। সেই থেকেই এই সুস্বাদু খাবারটি জায়গা করে নেয় মুঘলদের খাবার টেবিলেও। আর মুঘলরা পৃথিবীর যেখানেই গেছেন ছড়িয়ে দিয়েছেন এর স্বাদ ও গন্ধ।
শোনা যায়, রান্না করার এমন পদ্ধতি এসেছে কাজাকিস্তান ও উজবেকিস্তান থেকে। তবে ভারতীয় উপমহাদেশের খাবার তালিকায় এর নাম আসতে না আসতেই এর সাথে যোগ হয়েছে বাহারি সুগন্ধি মসলা, যা এর স্বাদকে বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ।
কাচ্চি বিরিয়ানি রান্নার সময় সুগন্ধি চাল, খাসীর কাঁচা মাংস, টকদই, জয়ফল, জয়ত্রী, গোলাপজল, জাফরান আর নানা রকম প্রয়োজনীয় মসলা মিশিয়ে হাড়ির মুখ আটার ডো দিয়ে এঁটে দিয়ে অল্প জালে বা কয়লার আগুনে বসিয়ে দেয়া হয়। কোন রকম নাড়াচাড়া ছাড়াই সময় নিয়ে দমে থেকে সবগুলো মিশ্রণ এক অসাধারণ স্বাদ তৈরি করে। অনেকেই ভাবছেন এত কিছুর কথা বললাম আর আলুর কথা বললাম না! তা কি করে হয়। কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে যাবে আর ‘একপিস আলু বাড়িয়ে দিয়েন মামা’ এই কথাটা দোকানীকে বলবেনা এমন খুব কম হয়। বড় বড় মাংসের টুকরোর সাথে বড় টুকরো করে কেটে জাফরান দিয়ে মেখে ভেজে বিরিয়ানির ভেতর যুক্ত করা দেওয়া হয় এই আলু, যার স্বাদই অন্য রকম।
ঢাকার ভেতর কাচ্চি বিরিয়ানির চাহিদা সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে পুরান ঢাকার কাচ্চি। তবে দিনে দিনে এর ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের অন্যান্য শহরেও। তবে বিশ্ব-দরবারে বহু দেশেই এর চাহিদা তুংগে। ঢাকাতে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী কাচ্চি বিরিয়ানির দোকানের পাশাপাশি ইদানিং ছোট কিংবা বড় রেস্তোরাঁগুলোতেও এই বিরিয়ানির পসরা সাজিয়ে বসেছেন প্রচুর খাদ্য-ব্যবসায়ীরা। কথায় কথায় ট্রিট চাওয়ার যুগে এক প্যাকেট কাচ্চি হয়ে যায় মন খুশি করার সবচেয়ে সহজ সমাধান। কাচ্চি বিরিয়ানির সাথে অনেকে বিভিন্ন পানীয় খেয়ে থাকলেও ঐতিহ্যবাহী বোরহানি এক্ষেত্রে অগ্র গন্য ।
বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হবে যদি কেউ বলে থাকেন যে “আমি কখনো কাচ্চি বিরিয়ানি খাইনি”। তবু আসলেই যদি এমনটা হয়ে থাকে তবে এই ঘরে বসে অর্ডার করতে পারা সুযোগের দুনিয়ায় আর একটা দিনও এই ঐতিহ্যকে না চেখে বসে থাকবেন না। ভোজনপ্রেমী বাঙালির খাবার তালিকায় এই মোঘল খাবারটি কি যাদু ছড়িয়ে রেখেছে তা নিজেই পরখ করে দেখে নিন।