রাত ১২ টা ১২ মিনিট। মাঝারি আকারের বাসটা আমি এবং আমার সঙ্গী দুইটা ছোটভাইকে যাত্রাবাড়ী আলম রেস্তোরার সামনে নামিয়ে দিয়ে মেয়র হানিফ মিয়া উরালসেতু দিয়ে মুহূর্তেই দৃষ্টিসীমানার বাইরে চলে গেল। আমার বাম কাঁধে একটা ডিএসএলআর ক্যামেরার ব্যাগ ঝুলানো, আর ডান কাঁধে জামাকাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই করা আরেকটা ব্যাগ। উদ্দেশ্য সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল। উড়ালসেতুর নিচে আসতেই চারদিকটায় কেমন যেন একটু নিস্তব্দতা আর অন্ধকার ভর করলো। নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়ে একটু আগানোর পরেই চোখে পরলো দুইটা যুবক খোশগল্প করছে আর সিগারেট ফুঁকছে (ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক)। আমার সারা শরীরে একটু মৃদু কাঁপুনি হল। পকেটে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে নিয়ে (ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক) ওদের সাথে গল্প করতে করতে লক্ষ্যের দিকে আগাতে থাকলাম। খানিক্ষন পরেই বাস টার্মিনালে আমরা পৌঁছে গেলাম। টার্মিনালের শেষ বাসেটির শেষ যাত্রী হিসেবে রওনা দিলাম আমরা। এবার গন্তব্য সীতাকুণ্ড।
ভোর ৫ টা ২৫ মিনিট। বাস থেকে নেমে মাটিতে পা রাখতেই রাতভরের ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা কেটে গিয়ে শরীরটা একেবারে সজীব আর প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। রাস্তা পার হলেই ছোট্ট একটা শহর। সীতাকুণ্ড শহর। আর শহরটার উপরে ছাতা হয়ে দাড়িয়ে আছে বিশাল বড় একটা পাহাড়, চন্দ্রনাথ পাহাড়। মনে হল কোন চিত্রশিল্পি মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকেছেন এই পুরো অঞ্চলটাকে। বেশ উত্তেজিত হয়ে গেলাম আমরা। কেনই বা হবোনা, পাহাড়ের চূড়া যে আমাদের চৌম্বকের মতো কাছে টানছে। শহরের কেন্দ্রবিন্দুতেই স্বল্প খরছে একটা আবাসিক হোটেলে উঠে পড়লাম আমরা। ঝটপট তৈরি হয়ে অটো-ভ্যানে চড়ে পড়লাম আমরা। এবার গন্তব্য পাহাড়ের চূড়া, চন্দ্রনাথের চূড়া।
পাহাড়ের পাদদেশে এসে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় আসবাপত্র (বাঁশ, পানির বোতল, ব্যাগ, ট্র্যাকিং শু) নিয়ে নিলাম। ১১৫২ ফুট পথ উঁচুতে আমাদের উঠতে হবে। চন্দ্রনাথ আমাদের স্বাগতম জানালো এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে। পাহাড়ি রাস্তা তার উপরে বৃষ্টি। আমাদের যাত্রা মোটেও সুবিধাজনক হবেনা তা আমরা খুব ভালভাবেই টের পেলাম। মিনিট ২০ ট্র্যাকিং এর পর চন্দ্রনাথ তার রূপ পাল্টে ফেললো। মেঘেদের চোখ রাঙ্গিয়ে সূর্য্ তার জ্যুতি ছড়িয়ে দিল পুরো চন্দ্রনাথে। যত উপরে উঠছি, প্রকৃতির সৌন্দর্য ততটাই বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। স্নিগ্ধ বাতাসের আবেশে চোখ বুজে আসছিলো। এখানকার কর্তৃপক্ষ চন্দ্রনাথের রাস্তায় একটু পরপরই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বেঞ্চি তৈরি করে দিয়েছেন। আমরা চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চুড়ায় উঠতে থাকলাম। পাহাড়ের রাস্তায় একটু পরপর দেখা মিলবে ছোট ছোট দোকান।
এখানের ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ী সামগ্রী শহর থেকে কিনে পিঠে বয়ে চন্দ্রনাথে নিয়ে আসেন। বিভিন্ন ধরনের শরবত, পাহাড়ি ফলমূল, বিখ্যাত পাহাড়ি আসবাপত্র বিক্রি করে থাকেন তারা। পাহাড়ে বসবাসরত উপজাতির সংখ্যা খুবই কম। অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ এবং নিরীহ এই জনগোষ্ঠী।
পাহাড়ের চূড়ার দিকে আপনার চোখে পড়বে একটা মন্দির,”বিরূপাক্ষ মন্দির”। মন্দিরটা অনেক পুরনো আর নতুন করে সংস্কার ও করা হয়নি। একটু জিরিয়ে চূড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আমরা। এবার আমাদের যাত্রায় অংশ নিলো দুইটা কুকুর। অবাক করা বিষয়, কুকুর দুইটি আমাদের চূড়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলো। একেবারে চূড়ায় পৌঁছে দিয়ে কুকুর দুইটি আবার তাদের সাবেক গন্তব্যে ফিরে যেতে থাকলো। স্থানীয় কেউ না থাকায় কুকুর দুইটির নাম জানা হয়নি। চন্দ্রনাথের চূড়ায় উঠে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। উপর থেকে সবকিছু খুবই ক্ষুদ্র মনে হয়েছিল। মনে হয়েছে- যে যত বড়, তার কাছে সবকিছু ততো ছোট মনে হয়। চন্দ্রনাথের চূড়ায় দেখা মিলবে “চন্দ্রনাথ মন্দির” এর। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এই মন্দিরের জন্যই চন্দ্রনাথ পাহাড় তৈরি করা হয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা অথবা প্রতিষ্ঠিত সময়ের ব্যাপারে কারোরই তেমন সুস্পস্ট ধারনা নেই। তবে স্থানীয়রা মনে করেন, একদা এক পুরোহিত এখানে ধ্যানে বসেন এবং এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। চন্দ্রনাথের চূড়া থেকে আপনি যত দূরে এবং নিচে তাকাবেন ততই মুগ্ধ হবেন। বুঝতে পারবেন- “The best view comes after the hardest climb.”