আয়তনে ছোট হলেও পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ হিসেবে খ্যাত আমাদের এই বাংলাদেশ। ছোট্ট এই দেশের দক্ষিনাঞ্চলে আছে ছোট, বড় নানারকম দ্বীপের সমাহার। ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্যে দ্বীপগুলো শীতের সময় অন্যরকম আবেদন নিয়ে আসে। দ্বীপে ক্যাম্পিং করে থাকা, ক্যাম্পফায়ার, নিজেরা রান্না করে খাওয়া, এসব কিছুর আকর্ষণ এড়ানো দায়। আর দ্বীপের মানুষজন, তাদের জীবনাচরণ থেকেও অনেক কিছু শেখার থাকে।
এরকমই কিছু দ্বীপ হচ্ছে আমাদের ভোলা জেলায় মনপুরা, চট্টগ্রাম জেলায় সন্দ্বীপ, নোয়াখালী জেলায় নিঝুমদ্বীপ, কক্সবাজার জেলায় দেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী। কক্সবাজারে আরো আছে প্রবাল দ্বীপ বা নারিকেল জিঞ্জিরা নামে ব্যাপক পরিচিত সেন্ট মার্টিন্স। এছাড়াও আছে শাহপরীর দ্বীপ, কুতুবদিয়া এবং সোনাদিয়া।
প্রতি বছর শীতেই দ্বীপে ঘুরে বেড়ানোর প্ল্যান থাকে। প্রায় সবগুলো দ্বীপেই যাওয়া হয়েছে। খুব কাছে থেকে দেখা হয়েছে দ্বীপের জীবনযাত্রা। একেক দ্বীপের আবার একেক বৈশিষ্ট্য!
কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নে ৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপটি সমুদ্রের বুকে অবস্থিত। মহেশখালী ক্যানেল দিয়ে দ্বীপটি কক্সবাজারের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। মহেশখালীর ঘটিভাঙা এসে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সোনাদিয়া খাল পার হলেই সোনাদিয়া দ্বীপ। প্রতিদিন জোয়ারের সময় পশ্চিম সোনাদিয়া থেকে ঘটিভাঙা পর্যন্ত মাত্র একবার একটি ট্রলার ছেড়ে আসে। আর এই ট্রলারটিই কিছুক্ষণের মধ্যে যাত্রীদের তুলে নিয়ে আবার ফিরতি পথে যাত্রা করে। এই যাওয়া আসা আবার নির্ভর করে জোয়ার-ভাটার উপর। এছাড়াও ঘটিভাঙা থেকে পায়ে হেঁটেও সোনাদিয়ার পূর্ব পাড়ে যাওয়া যেতে পারে।
গোধুলীলগ্নে যাত্রা শুরু করেছিলাম ঘটিভাঙা থেকে। কিছুটা কর্দমাক্ত পথ মাড়িয়ে উঠতে হয়েছিল নৌকায়। পুরো নৌকাটা যাত্রীতে পরিপূর্ণ হলে পরে ইঞ্জিন চালু করলেন মাঝি। তারপরের দৃশ্য শুধুই মনোমুগ্ধকর। এই সোনাদিয়া খালের পানি এতোই স্বচ্ছ ও টলটলে যে গোধুলীর সূর্যটার লালচে আভা যখন পানিতে পড়লো, মনে হচ্ছিলো লাল পলিশ করা কাঁচের উপর দিয়ে নৌকাটা যাচ্ছে। খালের দুইপাশে সবুজ প্যারাবন। সূর্যটা অস্ত যাওয়ার সময় কমলা আলো ছড়িয়ে দিল এক পশলা। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম শুধু। এমন মোহনীয় দৃশ্য দেখে অপলক তাকিয়েই থাকতে হয়!
সন্ধ্যা নেমে এসেছে যখন নৌকা ভিড়লো দ্বীপের পশ্চিম পাড়ে। নৌকা থেকে নামতেই পা ডুবে গেল গোড়ালি সমান কাদায়। এমনই কাদা যে জুতা আটকে গেল। পা ওঠানো যায় না। কেউ ধাক্কা দিয়ে, কাউকে টেনে ধরে সেই কাদা পার হতে হলো। সেই এক অভিজ্ঞতা! পুরো দ্বীপে কোন বিদ্যুৎ সংযোগ নেই।স্থানীয়রা সোলার পাওয়ার ব্যবহার করেন। চিরাচরিত শহুরে ঝলমলে আলোময় জীবন থেকে ছুটি নিতেই এখানে আসা। আবছা আলোয় হাঁটছিলাম আমরা ক’জন বন্ধু। আজকে রাতটা দ্বীপে ক্যাম্পিং করবো। আশরাফ ভাই সোনাদিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা আলমগীর ভাইয়ের সাথে আগেই কথা বলে রেখেছিলেন। ভাই আমাদেরকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। টিনের ছাউনি দেয়া, পরিষ্কার করে লেপা মাটির ঘর। সেখানে বাড়তি ব্যাগগুলো রেখে কেবল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আমরা সমুদ্রের পাড়ে রওনা হলাম। সমুদ্র যদিও বালিয়াড়ি থেকে বেশ দূরে। রাতে জোয়ারের কারণে মাঝে একটা খালের মতো থাকায় সমুদ্রে নামার উপায় ছিল না। কিš‘ নিস্তব্ধ পরিবেশে সমুদ্রের গর্জন ছিল শোনার মতো!
কেয়া-নিশিন্দার ঝোপ পেরিয়ে খোলামেলা এক জায়গা বেছে নেয়া হলো তাঁবু খাটানোর জন্যে। কয়েকজন এখানে তাঁবু পিচ করবেন। আলমগীর ভাইয়ের বাড়িতে যেয়ে রাতের খাবারের জন্যে খিচুড়ি রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে। তিথি আর তাসনীম চলে গেল রান্নার আয়োজন করতে। সাথে আমি আর তেহজীবও গেলাম। কি সুন্দর করে পেঁয়াজ কেটে, মরিচ কুটে, মসলা পিষে রান্না করছে দুইজন! আমি সেই মাটির ঘরে শীতলপাটিতে শুয়ে দেখতে দেখতে ঘুমিয়েই পড়লাম। হঠাৎই চোখ খুলে গেল। ততোক্ষণে রান্না শেষ হয়েছে। সবকিছু তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হলো। তখনই কেউ খাবে না। আমরা আগুন জ্বালিয়ে চারপাশে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এর ফাঁকে দেখি আলমগীর ভাই চটজলদি কয়েকটা ডাল জোগাড় করে দুই সারিতে বালুতে পুঁতে দিলেন। তার উপর একটা জালি দিয়ে দিলেন। তাসনীম দ্রুত হাতে মুরগী কেটেকুটে মসলা মাখিয়ে ফেললো। হয়ে গেল বারবিকিউ করার আয়োজন। গল্প আর আড্ডার মাঝে বারবিকিউটা যা চমৎকার হলো না! খিচুড়ি আর বারবিকিউটা খুব সুস্বাদু হয়েছিল।
এদিকে, আমাদের সিয়ামের জন্মদিন ছিল। দ্বীপে দুই একটা মুদি দোকান ছাড়া আর কিছু নেই। বাজারসদাই সব মহেশখালী থেকেই করা হয়েছিল। তখনই কয়েকটা স্লাইস কেক কিনেছিল তিথি। সেই কেকগুলোকে সাজিয়ে তার উপর চকলেট দিয়ে ‘হ্যাপি বার্থডে’ লিখে সিয়ামের জন্মদিন পালন করা হলো। আকাশে তখন সোনালী একটা চাঁদ। তার আলো পানিতে ঠিকরে পড়ছে। বারবার ছুটে যাচ্ছিলাম যদি সমুদ্রে যাওয়া যায়! কিন্তু নাহ! খালের পাশে দাঁড়িয়ে গর্জন শুনছিলাম শুধু। অনেকদূর হেঁটেছিলাম খালের প্রান্ত ধরে একা। গুনগুন করছিলাম গানের সুর। রাত অনেক হয়েছে। শুতে গেলাম। বাইরে তখন ক্যাম্পফায়ারের অগ্নিকুন্ডটা ওম দিচ্ছে।
ভোরে সূর্যোদয়ের আগেই ঘুম ভাঙলো। দ্বীপের ধবধবে সাদা বালিয়াড়ির উপর সকালের সূর্যের সোনালী রশ্মিটা পড়ছিল। যথার্থই নামকরণ হয়েছে এই দ্বীপের ‘সোনাদিয়া’। ঠান্ডা বালুতে বসে ছিলাম। সামনে দিয়ে রাখাল এক পাল গরু নিয়ে যাচ্ছিলো। ঝকঝকে নীল আকাশ, গরুর পাল হেঁটে যাচ্ছে, সমুদ্র ডাকছে, মাছধরা ট্রলারগুলো ছেড়ে যাচ্ছে গন্তব্যে। সবকিছুই ছন্দময় এখানে। দ্বীপের বাসিন্দাদের মূল পেশা মাছ ধরা, মাছ শুকিয়ে শুঁটকি করা। দেশের প্রধান শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র এই সোনাদিয়া। শুধু তাই নয়, এই দ্বীপটি বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
এখন ভাটার সময়। রাতের সেই খালটা এখন হেঁটেই পার হওয়া গেল। বিশাল বালুকাবেলা, সমুদ্রের স্বচ্ছ পানি আহবান করছিল যেন! আকাশের নীল রঙটা সমুদ্রে মিশে যাচ্ছিলো। সম্মোহিতের মতো এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তেহজীব তখন স্থানীয় এক বাচ্চা মেয়েকে পেয়েছে খেলার সাথী হিসাবে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, মেয়েটার নাম ঝুমা। তেহজীব বললো, ‘মা, ঝুমা আপু আর আমি বালুর প্রাসাদ বানাই?’ হেসে মাথা নাড়লাম। আহ! বালুর প্রাসাদ! এরকম কতো প্রাসাদই মানুষ মনের ভেতর গড়ে আর ভাঙে!
সমুদ্রের বালুচরে হাজার হাজার লাল কাঁকড়া। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ছোপ ছোপ লাল রঙ দিয়ে কেউ নকশা করে রেখেছে। কাছে গেলেই কাঁকড়াগুলো দ্রুত গর্তে লুকিয়ে যায়। দুই একটা হয়তো গর্ত থেকেই মুখ বের করে তাকিয়ে থাকে কৌতুহলের বশে। আবার একটু দূরে গেলে এরা গর্ত থেকে বের হয়ে আসে। বেশ লাগছিল লুকোচুরি খেলা কাঁকড়ার সাথে। ছেলেরা ফুটবল খেলতে চাইছিল। কিন্তু বল আনা হয়নি। অগত্যা দৌড় প্রতিযোগিতা, বুকডন দিয়েই সময় পার করছিল ওরা। আর সমুদ্র সৈকতটা এতো সুন্দর যে চুপচাপ বসেও সারাদিন অলস সময় কাটানো যায়।
ঝুমা বলছিল, এই বালুচরে নাকি সামুদ্রিক সবুজ কাছিম ডিম পাড়তে আসে। একটা ছাউনির মতো দেখালো। চারপাশে জাল দিয়ে ঘেরাও করা। বললো, এখানে ডিম আছে। ডিম ফুটে কাছিম বের হলে সেগুলো আবার সমুদ্রে ছেড়ে দেয়া হয়। বুঝলাম, এটা একটা ক”ছপ প্রজনন কেন্দ্র। ছোট্ট এই দ্বীপে অনেক কিছুই আছে দেখা যাচ্ছে।
আমাদের ফেরার সময় হয়ে গেল। তাঁবু গুটিয়ে নেয়া হলো। রাতে নিজেরা রান্না করে খেয়েছিলাম। আলমগীর ভাই আগেই বলেছিলেন, সকালে ওনার বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না হবে আমাদের জন্যে। সমুদ্রে গোসলের পর সারা গায়ে বালু লেগে ছিল। একে একে সবাই ভাইয়ের বাড়িতে যেয়ে নলকূপের পানিতে শরীর ধুয়ে নিলাম। তারপর খেতে বসে গেলাম। ভাত, আলু ভর্তা, ডাল আর ইলিশ মাছ। সেই মাছের বিশাল মাথা! ভাবীর রান্না খুব ভালো। আরাম করে খেলাম।
খেয়েদেয়ে বিদায় নিয়ে ফিরতি পথে রওনা হলাম। যে সময় বের হয়েছি, তখন ভাটা চলছে। জোয়ারের জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। সিদ্ধান্ত হলো, দ্বীপের পূর্ব পাড় ধরে হেঁটে যাবো মহেশখালীর ঘটিভাঙা পর্যন্ত। কৃষিজমির উঁচুনিচু আইল ধরে হাঁটতে হচ্ছিলো। আমরা বিশ্রাম নিয়ে, আস্তেধীরে হাঁটছিলাম। মাথার উপর গনগন করছে ভরদুপুরের সূর্যটা! ঘন্টা দুয়েক লাগলো পৌঁছাতে ঘটিভাঙা। ছেড়ে এলাম সোনাদিয়া। স্বর্ণদ্বীপটা বুকের গভীরে খুব আপন একটা জায়গা করে নিয়েছে।
দ্বীপগুলো আমাকে খুব টানে। হয়তো মানুষের মনের সাথে মিল আছে বলেই! দ্বীপগুলোর মতো আমরা মানুষরাও আজকাল খুব বিচ্ছিন্ন কিনা!