রেমা-কালেঙ্গা

by | জানু. 15, 2023 | Travelling

Traditional Khichuri hobe

Rema-Kalenga Wildlife Sanctuary

মাঝরাতে বৃষ্টির টিপটিপ শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। সকালের বাসে হবিগঞ্জ যাওয়ার কথা। বৃষ্টি হলে সেটা কিভাবে হবে ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। এলার্মের শব্দে যখন ঘুম ভাঙলো, বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। তৈরি হয়ে বের হবো, এমন সময় আবার শুরু হলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বের হলাম। মহাখালী থেকে আমাদের বাস। যাবো রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে হিট দ্য ট্রেইলের সাথে একটা ক্যাম্পিং ট্যুরে। রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এটি একটি শুকনো ও চিরহরিৎ বন এবং সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনভূমি। এছাড়াও এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল। সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় এর অবস্থান। 

প্রায় ১৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এই বনভূমি বিস্তার লাভ করতে শুরু করে ১৯৪০ সালের দিকে। তবে রেমা কালেঙ্গা অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৮২ সালে। ১৯৯৬ সালে বনের সম্প্রসারণ করা হয়। বনবিভাগের কালেঙ্গা রেঞ্জের চারটি বিটের (কালেঙ্গা, রেমা, ছনবাড়ী আর রশিদপুর) মধ্যে রেমা, কালেঙ্গা আর ছনবাড়ী বিস্তীর্ণ জঙ্গল নিয়ে রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য গঠিত। রয়েছে বেশ কয়েকটি পাহাড়-টিলা। এখানকার পাহাড়গুলোর সর্বোচ্চ উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬৭ মিটার।

রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমে আছে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি। এছাড়া ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্মও আছে।

রেমা-কালেঙ্গার বনে পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালীর মধ্যে বিরল প্রজাতির মালায়ন বড় কাঠবিড়ালীর একমাত্র বসবাস এই বনেই। তিন প্রজাতির বানর, কুলু, রেসাস আর লজ্জাবতী’র দেখা মেলে এ অভয়ারণ্যে। রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমে আছে প্রায় ১৬৭ প্রজাতির পাখি। (তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া)

বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালাম। মামুন ভাই, মাসুম ভাই, রাসেল ভাই, স্বপ্নীল ভাই, সব পরিচিত মুখগুলো দেখে ভালোই লাগছিল। সাড়ে আটটায় বাস। সকালের নাস্তার উদ্দেশ্যে গেলাম ধারে কাছের একটা হোটেলে। এর মধ্যে সবাই চলে আসলো। আমাদের সাথে আরেকটা বাবু ছিল, আয়াত। ওর আম্মু ইমি আপুকে আগেই চিনতাম। নতুন পরিচয় হলো শাওলিন, টুম্পা আপু, তুষার ভাই, ইমি আপুর বর আলমগীর ভাই আর মুকিতের সাথে। সবাই বসে নাস্তার অর্ডার দেয়া হলো। খাবার পর পানি খেতে যেয়ে আবিষ্কার করলাম, এই হোটেলে কোনো গ্লাস নেই! ছোট বোতলে করে পানি খেতে হয়। ঢাকার ভেতর হোটেলে এমনটা ঠিক দেখা যায় না।

বাসের সময় হয়ে এলো। বেশি একটা সময় লাগলো না শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছাতে। শায়েস্তাগঞ্জে পৌঁছে তিনটা সিএনজি নেয়া হলো। আধা ঘন্টার মতো লাগলো অভয়ারণ্যে পৌঁছাতে। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। আগের রাতে বৃষ্টি হওয়াতে কাদা ছিল অনেক। পৌঁছানোর পর গাইড নোমান ভাই আমাদের কটেজে নিয়ে গেলেন। সেখানেই আমাদের জিনিসপত্র রাখা হলো। যেহেতু পৌঁছাতে বেলা হয়ে গিয়েছে, দুপুরের খাবার খেয়ে ট্রেইলের উদ্দেশ্যে যাওয়া হবে, ঠিক করা হলো। সবাই যার যার মতো ফ্রেশ হয়ে খেতে গেলাম। খাবার ঘরটা আলাদা। মেন্যু দেখে জিভে জল চলে আসলো। সবজি, শুঁটকি ভর্তা, ঘন ডাল, মুরগী প্রচুর খাওয়া হলো।

ট্রেইলে যাওয়ার আগে অনেক সুন্দর সব ছবি তোলা হলো। আজকে আমরা যাচ্ছি আধা ঘন্টার ট্রেইলে। নোমান ভাই জ্ঞানী মানুষ। হাঁটতে হাঁটতে অনেক তথ্য দিলেন। রেমা-কালেঙ্গা বনের ভেতরেই আছে চারটি আদিবাসী স¤প্রদায়ের বসবাস। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের পাড়া আছে এই বনের ভেতরে। এছাড়াও সাঁওতাল, তেলুগু ও উড়ং আদিবাসীরও বসবাস আছে। ট্রেইলে চুপচাপ হাঁটলে দেখা যায় অনেক কিছুই। হনুমানগুলো দেখছিলাম এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফ দিচ্ছে, ঝুলছে। এদিকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। নিঝুম বনের ভেতর বৃষ্টির টিপটিপ শব্দ, পাখির ডাক অন্যরকম ভালো লাগে। লেকের পাশ দিয়ে রাস্তা। কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলে ওয়াচ টাওয়ার পাওয়া যাবে। টাওয়ার থেকে জঙ্গলের ভিউ বেশি সুন্দর। লেকের ধারেই আমাদের ক্যাম্পিংয়ের প্ল্যান। কিš‘ শেষ পর্যন্ত বৃষ্টির কারণে কি হবে বলা যাচ্ছে না কিছুই। সিলেট আর হঠাৎ বৃষ্টি, একে অপরের পরিপূরক।   

সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এলো বলে। আমরাও ফিরে গেলাম কটেজের দিকে। বাইরে কিছুক্ষণ বসে ছিলাম। বৃষ্টির তোড়ে সেটাও করা গেল না। বৃষ্টি থামলে পরে আমরা চায়ের দোকানে যাবো ভাবলাম। তেহজীব আর আয়াত তখন ঘরে বসে গান করছে, গল্প করছে। ওরা যাবে না। ইমি আপু আর আলমগীর ভাইও যাবেন না। দোকানে যেয়ে চা অর্ডার করে আড্ডা শুরু হলো আমাদের। কতো কথা, কতো হাসি! আড্ডার ফাঁকে জানা গেল, তুষার ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি ফেনী। আবার, শাওলিনের দাদীর বাড়ি ফেনী। আরো অনেক বিশ্লেষণের পর জানা গেল, আমিও কোনো এক ভাবে ওর ফুপ্পি হই! তেহজীব হয় ফুপাতো বোন! এরপর শাওলিন, তেজু আর মুকিত হয়ে গেল ফুপাতো ভাইবোন। এটাই হচ্ছে ট্যুরের মজা। রক্তের সম্পর্ক থাকুক আর না থাকুক, আন্তরিকতার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েই যায়। আমি তো প্রায়ই বলি, ট্যুরে গেলে কুম্ভের মেলায় হারানো ভাইবোন পাওয়া যায়। আর যে আনন্দটা হয়, তার কথা আর নাই বলি! 

আমরা আবার কটেজের দিকে চলে আসলাম। বারবিকিউয়ের আয়োজন হচ্ছে। আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে ছিলাম আমরা। গল্প হলো, গান হলো। অনুরোধে সাহস করে আমিও একটা গান গেয়েই ফেললাম। এভাবে অনেকটা সময় চলে গেল। এখানের লোকগুলোর রান্নার হাত যে এতো ভালো! বারবিকিউটা সেইরকম সুস্বাদু হয়েছিল। 

তেহজীব ঘুমাবে। ওকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভালো একটা ঘুম হলো। বৃষ্টির জন্যে সকালটা ছিল ভেজা আর ঠান্ডা। চারদিকে শুধু সবুজ। এর মাঝে লেকের ধারে তুষার ভাইয়ের হ্যামক ঝুলিয়ে আমরা সবাই খুব ফটোসেশন করলাম। হ্যামকটা বেশ সুন্দর। তারপর তাঁবুসহ সব তল্পিতল্পা গুটিয়ে কটেজে ফিরে চললাম। নাস্তা করে আবার বের হতে হবে। আজকে আমরা তিন ঘন্টার ট্রেইলে হাঁটবো৷ তারপর আজকেই ঢাকায় ফেরা। রেমা-কালেঙ্গার আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, খাওয়াদাওয়া। আমরা শুধু এটাই বলছিলাম যে, একটা জায়গার প্রতি বেলায় খাবার এতো ভালো হয় কি করে!! সকালের নাস্তাটাও ব্যতিক্রম হলো না। তারপর রঙ চা খেতে খেতে এক দফা কার্ড খেলা হয়ে গেল। 

এরপর বের হলাম। তিন ঘন্টার এই ট্রেইল অনেক জংলা। গাছপালা, ধানক্ষেত, লেবু বাগান, সবই আছে। বেশ কয়েকটা ছোট খালের মতো পার হতে হয়। দল বেঁধে বানর আসে ধান খেতে। এখানে লজ্জাবতী বানর আর চশমাপড়া হনুমান দেখা গেল। বিশাল গাছগুলো বনের সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। পথে এক জায়গায় মেছো বাঘের পায়ের ছাপও দেখালেন নোমান ভাই। এদিকে স্বপ্নীল ভাই মজা করে কোমরে কয়েকটা পাতা বেঁধে বনমানুষ সেজে মজা করছিলেন। হিট দ্য ট্রেইলের বিশেষায়িত বনমানুষ। সেইভাবেই যখন কটেজের দিকে ফিরছিলেন, এলাকার লোকজন যা অবাক হচ্ছিলো!

কটেজে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর চায়ের দোকানে আরেকবার ঝড় তোলার জন্য ঢুকলাম। চায়ের সাথে এই দোকানের গজাটা বেশ ভালো খেতে। ভরা পেটেও মিস করলাম না। এরপর শুধু মজার মজার খাওয়া আর রিল্যাক্স করার জন্য হলেও আবার রেমা-কালেঙ্গায় যাবো, ভাবছিলাম। আমাদের নিতে সিএনজি চলে এসেছে। সবুজ বনের মায়া কাটিয়ে এবার ফেরার পালা। 

Related Post
সুসং দূর্গাপুর

সুসং দূর্গাপুর

আমাদের ময়মনসিংহ ট্যুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল সুসং দূর্গাপুর ভ্রমণ। এটি একটি...

Subscribe To Our Newsletter

Subscribe To Our Newsletter

Join our mailing list to receive the latest news and updates from our team.

You have Successfully Subscribed!