খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটিৃ বাংলাদেশের এই তিন পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছি আমি। সেই সুবাদে বিভিন্ন পাহাড়ি খাবারের স্বাদও নেয়া হয়েছে। পাহাড়ে খুব জনপ্রিয় একটি খাবারের নাম হচ্ছে ব্যাম্বো চিকেন বা বাঁশের চোঙার ভেতর রান্না করা মুরগীর মাংস। পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের কাছেও ব্যাম্বো চিকেনের আবেদন অপরিসীম। শুধু মাংস নয়, মাছও রান্না করা যায় এভাবে। এর বাংলা কোনো নাম নেই। চাকমা ভাষায় একে বলে ‘চুমো গোরাং’। আর শহুরে ভাষায় আমরা বলি ব্যাম্বো চিকেন।
প্রথম খাগড়াছড়ি যেয়ে ব্যাম্বো চিকেন খেয়েছিলাম। এখনো মনে আছে, পাতলা স্যুপের মতো ঝোলটা। আদার ঝাঁঝালো গন্ধ মেশানো। কাঁচা মরিচের সুন্দর একটা ঝাল স্বাদ পাওয়া যায়। ভালোই লেগেছিল। এরপর অনেক জায়গায় যেয়েই খেয়েছি। একইরকম মজা লেগেছে। তবে সম্প্রতি এই খাবারের অন্যরকম একটা ভিন্নতার স্বাদ পেয়েছিলাম একটা ট্যুরে। সেটাই শেয়ার করছি।
রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ের বুকে জেগে ওঠা ছোট্ট একটা চর। নাম, আদার চর। রাতে ক্যাম্পিং করে পরদিন যাবো লংগদু নিত্যরঞ্জন দাদার নৌকায় চেপে। দাদা বললেন, ব্যাম্বো চিকেন তো অনেক খেয়েছেন। এইবার আপনাদের ব্যাম্বো কাঁচকি খাওয়াবো!”
এই চরে মূলত জেলেরা দল বেঁধে আসেন মাছ ধরতে। জাল ফেলে রাখেন সারারাত। সকালে যখন জাল টানেন, টাটকা রূপালী মাছগুলো লাফাতে থাকে। দেখতে এতো ভালো লাগে! সেই জেলেদের থেকেই ঝরঝরে শলাকার মতো কাঁচকি মাছ কেনা হলো। দাদা ঝটপট মাছ পরিষ্কার করে চলে গেলেন বাঁশের খোঁজে। এই রান্নার জন্য কিছুটা কাঁচা বাঁশ ভাল হয়। কাঁচা বাঁশে পানির পরিমাণ বেশি থাকায় সহজে পুড়ে যায় না। লম্বা সময় তাপে রেখে রান্না করা যায়।
সব ধরনের বাঁশে রান্না করা হলেও মূলত ডুলু বাঁশ এবং ফারোয়া বাঁশ ব্যবহৃত হয় বেশি৷ এগুলো আকারে বড় হয়। বাঁশের ভেতর মুরগী রান্না করতে হলে মাংসের টুকরো ছোট করতে হয়। আমরা যেহেতু ছোট মাছই রান্না করছি, তাই এই ঝামেলা ছিল না।
বাঁশ আনা হলে পরে মাছে মসলা মাখিয়ে প্রস্তুত করা হলো। একটা গামলায় মাছগুলো পেঁয়াজ কুচি, ছেঁচে নেয়া আদা, পাহাড়ি ছোট কাঁচামরিচ, লবণ, সামান্য হলুদ, এবং সরিষার তেল দিয়ে মাখানো হলো। তারপর বাঁশের ভেতর ঢুকিয়ে কলাপাতা দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দেয়া হলো। বাঁশটা কিন্তু এমনভাবে কাটা হয় যেন অন্যপাশে বদ্ধ থাকে। সবদিকে যেন সমানভাবে তাপ লাগে, তাই নিত্যদা মাঝেমধ্যেই বাঁশ ঘুরিয়ে দিচ্ছিলেন।
আমি ভাবছিলাম, বুঝবে কিভাবে তরকারি হয়েছে কিনা। দেখলাম, বাঁশের কলাপাতা দিয়ে আটকে দেয়া মুখটা থেকে বুদবুদের মতো বের হচ্ছে। তরকারি থেকে পানি উঠে ঝোলের মতো অংশটা বের হয়ে আসলেই বোঝা যায়, রান্না হয়ে গিয়েছে। মিনিট বিশেকের মতো লাগলো দেখলাম।
নামিয়ে নেয়া হলো বাঁশটা। কলাপাতার মুখটা সরিয়ে ফেলতেই চমৎকার একটা ঘ্রাণ এসে লাগলো নাকে। আর দেরি করলাম না। গরম গরম ভাতের সাথে সুস্বাদু ব্যাম্বো কাঁচকি দিয়ে উদরপূর্তি করে ফেললাম। রান্নাটা এতো চমৎকার হয়েছিল! এতো কম উপকরণ দিয়ে এতো ভালো খাবার রান্না করা যায় আমার ধারণাই ছিল না। তবে পাহাড়িরা কিন্তু সাধারণত কম মসলায় রান্না করে।
ঘোরাঘুরি মানেই ভরপেট খাওয়াদাওয়া। আর যেখানেই খাবারের ভিন্নতা, সেখানেই আমার আকর্ষণ। যদিও আমি খুব ভোজনরসিক মানুষ না, তবে বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ নিতে আমার ভালো লাগে। পাহাড় তাই শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যেই নয়, এরকম খাবারের বিচিত্রতার জন্যেও ভালো লাগে।