বিউটিফুল বাংলাদেশ: ব্রাহ্মণবাড়িয়া

by | জানু. 14, 2023 | Travelling

Traditional Khichuri hobe

Brahmanbaria has different historical and beautiful places

আমাদের উৎসাহের শেষ নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাচ্ছি। এই একটা জেলায় যাওয়াই বাকি রেখেছিলাম। এখানে গেলে এবার ৬৪ জেলায় পা ফেলা হবে। আরেকটা কারণ ছিল খুশী হওয়ার। বিজয়ের মাসে যাচ্ছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যে জেলার ভূমিকা ছিল অসীম। আনন্দের সাথে বাসে উঠে বসলাম। 

যেয়ে নামলাম নাসিরনগর উপজেলায়। এখানের হরিপুর ইউনিয়নে আছে হরিপুর বড়বাড়ি, যা ১৮শ শতাব্দীতে জমিদার কৃষ্ণপ্রসাদ রায় চৌধুরী কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল।

হরিপুর বড়বাড়ি তিতাস নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। বাড়িটি ‘হরিপুর জমিদারবাড়ি’ বা ‘হরিপুর রাজবাড়ি’ নামেও পরিচিত। ভাবছিলাম, তিতাস নদীর ভরা যৌবনে নিশ্চয়ই এই বাড়িটার সৌন্দর্য্য উপচে পড়তো!

হরিপুর বড়বাড়ি একটি দুই গম্বুজবিশিষ্ট তিনতলা বাড়ি। প্রাসাদটি প্রায় ৫ একর জমির উপর নির্মিত যাতে ৬০টি ঘর আছে। নাট্যশালা, দরবার হল, গুদাম, গোশালা, রন্ধনশালা, প্রমোদের কক্ষ, খেলার মাঠ, মঠ, মন্দির, মল পুকুর, আরো অনেক কিছু নিয়ে জমজমাট ছিল এই রাজবাড়ি। বাড়িটির মূল ফটকের সামনে শান বাঁধানো ঘাট ছিল যা নদীতে গিয়ে নেমেছে এবং এর দুই পাশে দুইটি মঠ। এই অঞ্চলের মানুষ যাতায়াতের জন্য নদীপথ ব্যবহার করতো, হয়তো তাই আকর্ষণীয় ঘাটটি বানানো হয়েছিল। সবই ‘ছিল’ বলছি কারণ, এখন সবকিছুই মোটামুটি ধ্বংসের মুখে। ভেতরে ঢুকে দেখি, রাজবাড়ির একেক ঘরে একেক পরিবারের বসবাস। তবে আমরা যখন গেলাম, বাড়িটি রঙ করা হচ্ছিলো। যতোটুকু জানি, এটা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নেয়া হয়েছে। আশা করা যায়, বাড়িটি দখলমুক্ত হয়ে তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। 

এই বাড়ি কিন্তু শুটিং স্পট হিসাবেও ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষভাবে বলা যায়, হুমায়ুন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবিটির কথা। 

রাজবাড়ি দেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে চলে গেলাম। শহরের ফারুকী পার্কে খুব সুন্দর একটি শহীদ স্মৃতিসৌধ আছে। জেলার মানুষেরা এই স্থানটিকে বর্তমানে অবকাশ বলে ডাকে। এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পেছনে আছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তান বাহিনীর একটি ট্যাংক নষ্ট হয়ে যায়। এটি ছিল উভচর ট্যাংক। গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধযানটিকে ফেলে দিতে চায়নি পাকিস্তান। কিন্তু যুদ্ধের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে ট্যাংকটিকে ফেলে রেখেই পেছনে হটতে বাধ্য হয় তারা। দেশ স্বাধীন হবার পরে মুক্তিযোদ্ধারা ট্যাংকটিকে সরিয়ে শহরের ফারুকী পার্কে এনে স্থাপন করেন। 

কিন্তু এটি এখানে বেশিদিন থাকতে পারেনি। ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারের আমলে দেশে সামরিক আইন জারি হয়। তখন এই ট্যাংকটিকে ফারুকী পার্ক থেকে সরিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু একে এখান থেকে সরানোর পক্ষে ছিল না কেউ। কুমিল্লা নেবার উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। সেখানকার সামরিক যাদুঘরে স্থান হবে এটির। সেজন্য তৎকালীন জেলা প্রশাসক, পৌর চেয়ারম্যান এবং আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে সেনা কর্মকর্তার সাথে একটি সমঝোতা হয়। সমঝোতা অনুসারে ট্যাংকটি এখান থেকে নিলে এখানে মুক্তিযুদ্ধের একটি মনোরম স্মৃতিসৌধ তৈরি করে দিতে হবে।

এই প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতায় ১৯৮৪ সালে ফারুকী পার্কে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে সময়ে সময়ে এর অনেক উন্নয়ন করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে এখানে মেলা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। স্মৃতিসৌধটা আসলেই সুন্দর। আবার বাচ্চাদের জন্য দোলনা, স্লিপার এগুলোও আছে। টুকটাক খাবার দোকান আছে। তেহজীবের ভালোই সময় কাটলো।

দুপুরে খেয়ে আমরা কোল্লাপাথরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। কোল্লাপাথর অঞ্চলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শেষ দিকে ভারতের কাছে অবস্থিত। এর পাশ দিয়েই বয়ে গেছে সালদা নদী। এই নদী ধরে অনেক মানুষ ভারতে প্রবেশ করেছে। এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে প্রায়ই পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হতো মুক্তিযোদ্ধাদের। স্থানে স্থানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হতেন। তাদের কাউকে পাওয়া যেতো আর কাউকে পাওয়া যেতো না। যাদেরকে পাওয়া যেতো তাদের মৃতদেহ বাংলাদেশের সীমানায় কিংবা ভারতের সীমানায় কবর দেয়া হতো। সেসব কবর হতো বিক্ষিপ্ত ও পরিচয়হীন। আবদুল মান্নান নামে এ অঞ্চলের একজন ব্যক্তি শহীদদের মরদেহ দেখে খুব ব্যথিত হন। মুসলিম নিয়ম অনুসারে লাশকে গোসল করিয়ে, কাফনের কাপড় পরিয়ে, জানাজা দিয়ে কবর দিতে হয়। তিনি তার স্ত্রী, পুত্র ও গ্রামবাসীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ সংগ্রহ করতে থাকেন এবং সেগুলোকে গোসল, কাফন ও জানাজার মাধ্যমে কবর দিতে থাকেন। একে একে মোট ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার স্থান হয় সেখানে। 

যুদ্ধের পরে আবদুল মান্নান ও তাঁর স্ত্রী প্রয়াত হলে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে কবর দেয়া হয়। দেশ স্বাধীন হবার পরে তারা কবরের এই জমিটি এবং এর আশেপাশের আরো কিছু জমি বাংলাদেশ সরকারের নামে দান করে দেন। দানের শর্ত ছিল সরকারের পক্ষ থেকে সমাধিস্থলটিকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে এবং এখানে একটি স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হবে। ধীরে ধীরে এখানে স্মৃতিসৌধ, স্মৃতিফলক, কবর প্রাচীর, নিরাপত্তা দেয়াল, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, রেস্ট হাউজ, পুকুর, বাঁধানো ঘাট, মসজিদ, বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। 

বর্তমানে রেস্ট হাউজের তত্ত্বাবধানে আছেন প্রয়াত আবদুল মান্নান সাহেবের পুত্র মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম। ওনার সাথে কথা হলো। সেক্টর ২ তে যুদ্ধ করেছেন খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দারের অধীনে। তাঁদের গল্প শোনালেন। রেস্ট হাউজের ভেতর যুদ্ধের সময়ের অনেক ছবি, লেখা একটা ঘর জুড়ে। আমি ওগুলো দেখছিলাম। বড় ভালো লাগছিল! রাতে আমরা রেস্ট হাউজেই ছিলাম। এতো ঠান্ডা জায়গাটা! সকালে উঠে রওনা হলাম যখন, আমি মনে হয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম, সহ্য হচ্ছিলো না। তবে জায়গাটা ভীষণ নিরিবিলি। ভালো লেগেছে।  

রিকশা নিয়ে ফেরার পথে আমরা সালদা গ্যাসক্ষেত্র বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখলাম। এটা বাংলাদেশের ১৯তম গ্যাসক্ষেত্র। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, এখানকার দুটি কূপ থেকে বর্তমানে গ্যাস উত্তোলন করা হয় এবং ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ রয়েছে।

কিছুটা এগিয়েই দেখা গেল কসবা সালদা নদী যুদ্ধের একটা স্মৃতিস্মারক। মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ১৯৭১ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই সালদা নদী অঞ্চলে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। ৮ অক্টোবর ক্যাপ্টেন গাফফারের নির্দেশে মুক্তিবাহিনী সালদা নদী রেলস্টেশন দখলের উদ্দেশ্যে পাক বাহিনীর চারটি বাংকার দখলে নেয়। বিপুল অস্ত্রশস্ত্র পাওয়ার পাশাপাশি এই এলাকাও শত্রুমুক্ত হয়। সিমেন্টের দেয়ালে খোদাই করে চমৎকার একটা মানচিত্র বানানো আছে।

এরপর আমরা গেলাম লক্ষ্মীপুরে। সেখানে একটি স্থানে ১৩ জন শহীদের একটি সমাধিস্থল আছে। এ অঞ্চলের যুদ্ধে শহীদ যোদ্ধাদেরকে এখানে সমাহিত করা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর কমান্ডার মোহাম্মদ আইনুদ্দিন এখানে শায়িত সকল মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা করে একটি সাইন বোর্ড স্থাপন করেন। উল্লেখ্য, এখানে শহীদ সকলেই ছিল তার সহযোদ্ধা। পরবর্তীতে এলাকাবাসী ও মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলা সদরে এই সমাধিস্থলটির উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের দাবী করেন। সেই দাবীর প্রেক্ষিতে এখানে একটি বেষ্টনী দেয়াল ও প্রতিটি সমাধিতে একটি করে সমাধি ফলক নির্মাণ করা হয়।

আমরা আখাউড়া চলে গেলাম। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধিস্তম্ভ আছে আখাউড়া থানার দরুইন গ্রামে। ১৯৭১ সালের ১৭ ও ১৮ এপ্রিল এই অঞ্চলে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল যুদ্ধ হয়। ১৮ এপ্রিল সকালে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল, মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়েছিল এমন আবহাওয়ায় পাকিস্তানীরা আক্রমণ করবে না। কিন্তু অতর্কিত হামলা করে বসলো পাকবাহিনী  এবং ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলো। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধের মাঠ থেকে সরে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে সরে যেতে হলেও কোন একজনকে বিপক্ষ দলকে ঠেকানোর কাজটা করতে হবে যেন বাকিরা পালাতে পারে। 

দরুইনে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পাকিস্তানীদেরকে ঠেকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সিপাহী মোস্তফা কামাল। ৮০০ রাউন্ড গুলি সহ একটি এলএমজি নিয়ে চারদিক থেকে নিরাপত্তা দিতে লাগলেন মুক্তিবাহিনীকে। প্রায় এক প্লাটুন মুক্তিসেনা নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যায়। কিন্তু মোস্তফা কামালকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে পাকিস্তানী সৈন্যরা। এর মাঝে তাঁর এলএমজির গুলিও শেষ হয়ে যায়। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে তিনি সেখানে শহীদ হন। দরুইন এলাকাবাসী ভালোবাসার সাথে তাকে একটি পুকুর পাড়ে সমাহিত করে। পরে কবরটি পাকা করা হয় এবং এর পাশে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ভালো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়ে কবরটা। সামনে প্রবেশ পথে একটা তোরণও বানানো হয়েছে। 

বের হয়ে বাসস্ট্যান্ডে চলে গেলাম। ঢাকার পথে রওনা হলাম। এর সাথে আমাদের ৬৪ জেলায় পা ফেলার লক্ষ্য পূরণ হলো। পা ফেলেছিই বলা যায়,

সব দেখে শেষ করতে পারিনি। এখন ইচ্ছা আছে, বাংলাদেশের আরো যে জায়গাগুলো আমরা দেখিনি, সেগুলো এক্সপ্লোর করার…. নতুন কোন গল্প লেখার….

Related Post
রেমা-কালেঙ্গা

রেমা-কালেঙ্গা

মাঝরাতে বৃষ্টির টিপটিপ শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। সকালের বাসে হবিগঞ্জ যাওয়ার কথা। বৃষ্টি হলে...

সুসং দূর্গাপুর

সুসং দূর্গাপুর

আমাদের ময়মনসিংহ ট্যুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল সুসং দূর্গাপুর ভ্রমণ। এটি একটি...

Subscribe To Our Newsletter

Subscribe To Our Newsletter

Join our mailing list to receive the latest news and updates from our team.

You have Successfully Subscribed!