পাহাড়। সমুদ্র। বন্দর। চট্টগ্রামের কথা ভাবলে আর কী মাথায় আসে? ওহ হ্যাঁ, মেজবান আছে তো! মেজবান হল চট্টগ্রামের স্মারক ও বাহক। এটি এ অঞ্চলের মানুষের ঐতিহ্যের অংশ। চট্টগ্রামের মানুষজন তাদের এই ঐতিহ্যে গর্ববোধ করে। মেজবানকে অনেকসময় ‘মেজবানি’-ও বলা হয়ে থাকে। তবে স্থানীয়রা একে ‘মেজ্জান’ বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
মেজবানের ঊৎপত্তি নিয়ে অবশ্য ধোয়াঁশা রয়েছে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মেজবানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। কেউ মারা গেলে, আকিকা কিংবা বড় কোন সাফল্য আসলে সাধারণত মেজবানের আয়োজন করা হয়। এমনকি কোনো নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান হলেও মেজবানের আয়োজন করা হয়।
মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষরাই সাধারণত মেজবান আয়োজন করতে পারে। বাড়ীর উঠানে কিংবা কমিউনিটি সেন্টারে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। শহুরে পরিবেশ হলে কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চট্টগ্রামের প্রাক্তন মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীর মেজবানে ১২টি কমিউনিটি সেন্টারে প্রায় এক লক্ষ মানুষকে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। এ ধরনের ঘটনা খুব-ই কম ঘটে তবে কোনো বিত্তশালী পরিবার মেজবান আয়োজন করলে দুয়েকহাজার মানুষকে অনায়াসেই আপ্যায়ন করা হয়।
মেজবানের মূল আকর্ষণ হলো খাবার। খাবার-ই মেজবানকে অন্যান্য সাধারণ ভুরিভোজ আলাদা অবস্থানে রাখে। মেজবানের খাবার তালিকায় থাকে সাদা ভাত, গরুর মাংসের তরকারি, মূলা/লাউ এর তরকারি, মুগডাল এবং মাঝেমধ্যে নেহারি ও থাকে। অতিথি তালিকায় অমুসলিম কেউ থাকলে তাদের জন্য মাছ বা মুরগির তরকারির ব্যবস্থা করা হয়।
মূলত রন্ধন পদ্ধতির কারণেই মেজবানের খাবার অনন্য উচ্চতায় থাকে। বাবুর্চি সাহেব খুব যত্নের সাথে প্রতিটি খাবার রান্না করে থাকেন। মেজবানে ভিন্ন রকমের মশলাপাতি ব্যবহৃত হয়। সবগুলো মশলা-ই হয় হাতে পেষা। এমনকি রান্নার কাজে ব্যবহৃত চুলাও হয় ভিন্ন ধরনের এবং বাবুর্চি নিজেই এই চুলা বসান। রন্ধনপ্রণালীর সব কাজে বাবুর্চির কথা-ই শেষ কথা। আয়োজকরা খাবারের ব্যাপারে তার সাথে শলা পরামর্শ করে এবং তাঁর জন্য রান্নার যাবতীয় সরঞ্জামের ব্যবস্থা করে। অনুষ্ঠানের দিন বাবুর্চি সাহেব তার চেলাদের নিয়ে রান্নার কাজ করেন। তিনি ভোর থেকেই চুলা জ্বেলে দেন। রাতের অনুষ্ঠান হলে বিকেলের আগেই রান্নার কাজ শেষ করা হয় এবং দুপুরের অনুষ্ঠান হলে সকাল ফুরোবার আগেই রান্নার কাজ শেষ করা হয়। মেজবানের রন্ধনপ্রণালী আয়ত্ত করতে একজন বাবুর্চির অনেক সময় এবং সাধনার দরকার হয়। তাঁর এই পরিশ্রম শেষ পর্যন্ত বিফলে যায় না। কারণ শেষ পর্যন্ত তাঁর রান্না হয় অতুলনীয়। গরুর মাংস যত ভালোভাবেই রান্না করা হোক না কেন, সেটা কখনো মেজবানের গরুর মাংসের মত সুস্বাদু হয় না!
মেজবানে সাধারণত সবাই যেতে পারে। আয়োজক পরিবার তাদের পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবদের দাওয়াত করে থাকে। আশপাশের এলাকার লোকজনও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। মহিলা এবং পুরুষদের জন্য আলাদা জায়গায় খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা করা হয়। যেহেতু অনেক বেশি মানুষ অংশ নেয়, তাই স্বাগতিকরা ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে অ্যাপায়ন করতে পারে না। ফলে সবাইকে নিজ দায়িত্বে খেয়ে নিতে হয়। মেজবানে খাবার পরিবেশন করা হয় ব্যাচ হিসেবে। যতক্ষন অতিথিরা অভুক্ত থাকে এবং খাবার বাকি থাকে, ততক্ষন ব্যাচের পর ব্যাচ খাবার পরিবেশন করা হয়। পুরো অনুষ্ঠানজুড়েই দেখা যায় ওয়েটাররা খাবার হাতে দৌঁড়ায় এবং লোকজনকে পথ ছেড়ে দেওয়ার জন্য চেঁচামেচি করে। এ যেন এক এলাহী কান্ড।
বর্তমানে অনেক রেস্তোরাঁ মেজবানের খাবার বিক্রি করে থাকে। তবে এসব রেস্তোরাঁর পরিবেশ এবং খাবারের স্বাদ কখনো একটি সত্যিকারের মেজবানের সাথে মিলবে না। মেজবানের সেই উত্তেজনা, সেই রোমাঞ্চ অতুলনীয়। সেই স্বাদ নিতে হলে আপনাকে মেজবানে অংশ নিতে হবে।