আমাদের এই বিশাল ভারতীয় উপমহাদেশের খাবার হিসেবে খিচুড়ি একটা ঐতিহ্যের নাম। যুগের পর যুগ ধরে এই লোভনীয় খাবারটি দেখিয়ে এসেছে তার নানার রূপ ও স্বাদ। উপকরণের তালিকায় কেবল চাল আর ডাল হলেই সই, তবে রন্ধন কৌশলের ভিত্তিতে এর সাথে যোগ হয় হরেক রকম মসলা ও সবজির বাহার। ভুনা গরুর মাংস, খাসীর মাংস, মুরগী, হাঁস সহযোগে এ ভোজটি কবজি ডুবিয়ে খেয়ে যাচ্ছে খাদ্যপ্রেমিরা এর সেই জন্মলগ্ন থেকে। শুধু কি তাই! নানা রকম ভর্তা, ডিম ভাজা, শুটকি, চাটনি, বোরহানি এর সাথে যোগ করছে আরো আরো স্বাদ। এ যেন এক স্বাদের হোলি খেলা।
বর্ষায় বাঙালী এমনিতেই একটু আত্মভোলা হয়ে যায়, তার ওপর খিচুড়িটা যদি খাবার টেবিল মাতিয়ে রাখে তাহলে আর কী লাগে! বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি আর বাঙালীর এই আদি সম্পর্কটা কখনও আড়াল করা যায় না।
যেন মেঘ গুড়গুড় আওয়াজ কানে এলেই পেটটা খিচুড়ি খিচুড়ি করতে থাকে, নাকটাও ঘুরে ফিরে সেই ঘ্রাণ ই পেতে চায়। বাইরে ঝুম বৃষ্টি আর হাতে খিচুড়ির প্লেট থাকলে কোথা থেকে এক চিলতে হাসি এসে মুখে সেঁটে যায়। কোথায় নেই এর ছোয়া? আইন-ই-আকবরী’র গল্পে পাওয়া শাহী পাত্র থেকে শুরু করে খড়কূটোয় জ্বলা চুলোর ওপর চাপানো হাড়ির ভেতর পর্যন্ত এই চমৎকার খাবারটি পাওয়া যায়। চাল চুলোহীন মানুষের কাছেও যেন এ এক সহজ খাদ্যের সমাধান। সেই পুরনো দিন থেকে ইতিহাস ঘেটে দেখলে বিভিন্ন আন্দোলন, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, অন্ত্যেষ্টিকৃয়া, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা বনভোজনের সহায়ক খাবার হিসেবে খিচুড়িই যেন একমাত্র সম্বল।
এই স্বাদের খাবারটা যেমন পুষ্টিগুণ সম্পন্ন তেমনই সহজপাচ্য। সহজে হজম হয় বলে শিশুর খাবারের তালিকায় এর নাম থাকেই। পুষ্টিগুণের কথা যখন আসলো তখন বলতেই হয় যে এক প্লেট খিচুড়িতে প্রায় ১৭৭ ক্যালোরি থাকে। যেহেতু এক এক এলাকায় খিচুড়ি রান্নার প্রচলন এক এক রকম তাই রান্নাভেদে এর ভেতর ভিটামিন, আয়রন আর ক্যালসিয়ামও থাকে পর্যাপ্ত যা শরীরে শক্তি যোগানোর পাশাপাশি শরীর থেকে বিষাক্ত বর্জ্র নিঃসরণে সাহায্য করে। শর্করা ও প্রোটিনে ভরপুর এ খাবারটা তাই চিকিৎসক ও ব্যয়াম প্রশিক্ষকদের উপদেশের তালিকায় প্রায়ই থাকে।
কালের পরিক্রমায় এই খিচুড়িকে আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসতে দেখেছি। দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোর মানচিত্রের ওপরে বয়ে যাওয়া স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন যুদ্ধ, বিক্ষোভ, আন্দোলন এর মধ্যে এই খাবারটি শক্তি জুগিয়ে এসেছে যোদ্ধা, বিক্ষোভকারীদের ও ঔপনিবেশীকদেরও। খিচুড়িকীর্তণে লাখ কথাও কম পড়ে। তাই সবশেষে বলা যায়, জাত-পাত, শত্রু-মিত্র নির্বিভেদে, সকলের হৃদয় থেকে পেট, অবিসংবাদিত ভাবে জয় করার কৃতিত্ব খিচুড়ির একচেটিয়া।