একজন বাঙালি খাদ্যপ্রেমী হোক বা না হোক, গরুর মাংসের কাছে সে প্রায় কুপোকাত। যে পরিমাণে যতই কম খেয়ে থাকুক অথবা যতই ডায়েট চার্ট অনুসরণ করুন না কেন, যেখানে গরুর মাংসের আয়োজন সেখানে একটা উন্মাদনা কাজ করে। কিছু মানুষের কাছে তো গরুর মাংস রান্না মানেই বিশেষ কোন উপলক্ষ্য। আর যত রকম পদই থাক না কেন, গরুর মাংস ছাড়া যেন কখনোই একটি ভালো উদ্যাপন সম্পন্ন হতে পারে না। বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী এই গরুর মাংস রান্নার বহু রকম প্রকৃয়া রয়েছে। ‘কালাভুনা’ তার মধ্যে অন্যতম।
এই রেসিপিটির উৎপত্তি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল চট্টগ্রামে। এই রেসিপিটা দেখতে পোড়া পোড়া কালো হওয়ার কারণে এর নাম কালাভুনা। অনেকেই মনে করেন মাংস বারবার ভাজার মাধ্যমে এর রঙ কালো হয়ে যায়। কিন্তু, আদতে তা নয়। চট্টগ্রামের এই ঐতিহ্যবাহী কালাভুনা রান্নার আসল রহস্যই হলো মসলার ব্যবহার। বিভিন্ন মসলার সঠিক ব্যবহারই এই রেসিপিকে কালো দেখাতে সাহায্য করে। এই খাবার তৈরির ধরনটা একটু ভিন্ন। তাই, স্বাদ, সুবাস বা রঙ যাই বলি না কেন এটি অন্যান্য খাবারের চেয়ে একেবারে আলাদা।
তবে গরুর মাংস ব্যবহারই এর সঠিক স্বাদ এনে দেয় এবং এটাই বেশি জনপ্রিয়। চট্টগ্রামে এই খাবারটি যেকোনো উৎসব, উপলক্ষ বা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়। আজকাল শুধু চট্টগ্রামই নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ এই মুখোরোচক খাবারটি পছন্দ করে। আকিকা, জন্মদিন, বিয়ে, নতুন শিশুকে স্বাগত জানানো, বেবি শাওয়ার বা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ ভোজের আয়োজনে কালাভুনা থাকাটা একরকম বাধ্যতামূলক। এই খাবারের জনপ্রিয়তা এত বেশি যে কালাভুনা প্রেমীরা বিদেশে গেলেও তাদের খাবার মেন থেকে এই পদটি বাদ দিতে পারেন না। তারা বিদেশে প্রচলিত বিভিন্ন বাঙালি অনুষ্ঠানে এই বিশেষ খাবারটি রান্না করার চেষ্টা করেন এবং আমাদের ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন।
যখনই কেউ কোথাও এই মজাদার খাবারটা চেখে দেখার সুযোগ পেয়েছে, তাদের বেশিরভাগেরই পছন্দের তালিকার অংশ হয়ে গেছে। সরিষার তেল আর রসুন ভাজার ঘ্রাণ এতে যোগ করে এক জাদুকরী স্বাদ। শোনা যায়, চট্টগ্রামে এই খাবারটি রান্নার জন্য বিশেষ রাধুনী রয়েছে, যাদেরকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অনুষ্ঠানে রান্নার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। চট্টগ্রামের এক একটা বিয়ে বাড়ি কালাভুনা ছাড়া যেন কল্পনা করা যায় না। এটি সেখানকার যেকোন অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ।
এখন শুধু চট্টগ্রামেই নয়, কালাভুনা সারা দেশের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়। সময়ের অভাবে খাদ্যপ্রেমীরা চট্টগ্রামে এসে কালাভুনার স্বাদ নিতে না পারলেও তাদের জন্য দেশের বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা খুবই সুবিধাজনক ব্যবস্থা রেখেছেন, যাতে করে তারা চট্টগ্রামের এই ঐতিহ্যবাহী স্বাদ থেকে বঞ্চিত না হয়।
কালাভুনা ভাত, পোলাও, রুটি, পরোটা, লুচি বা নানের মতো বিভিন্ন ধরণের আইটেমের সাথে পরিবেশন করা যেতে পারে। এই খাবারটি শুকনো দেখালেও আসলে তা বেশ রসালো হয়ে থাকে তাই মানিয়ে যায় সবকিছুর সাথেই। যারা এর আঙুল চেটে খাওয়া স্বাদ থেকে এখনও বঞ্চিত আছেন তারা চটজলদি চেখে দেখতে পারেন। জীবনে অন্তত একবার হলেও এই সুস্বাদু খাবারটি খেয়ে দেখা উচিত যাতে এর জিভে জল আনা স্বাদের অভিজ্ঞতা সকলের হয়।