ঝালমুড়ি, নাম শুনলেই মুখে ঝালঝাল স্বাদ এবং খাওয়ার সময় চোখে পানি চলে আসা এই খাবারটা বাংলাদেশ ও ভারতে খুবই জনপ্রিয়। মূল উপকরণ মুড়ির সাথে চানাচুর ও নানারকম মশলার সমন্বয়ে তৈরি হয় ঝালমুড়ি। সাধারনত ঝালমুড়ি রাস্তাঘাট, ফুটপাত, স্কুল-কলেজের সামনে, পার্কের সামনে এবং বিভিন্ন মেলায় ফেরি করে বিক্রি করা হয়। সাশ্রয়ী মূল্যের খাবার হওয়ায় এটি বাঙ্গালি জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে যা এক কাপ গরম কফি বা চা এর সাথে সবাই উপভোগ করেন। ঝালমুড়ি বিক্রেতাকে আমরা ‘ঝালমুড়িওয়ালা’ বলে থাকি।
ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ অঞ্চলে উৎপত্তি হয়ে বর্তমানে বাংলাদেশসহ পশ্চিম বঙ্গে এই খাবার বিশেষ জনপ্রিয়। মন্ডাক্কি, মুন্ডালু এবং চুরমুরির বিভিন্ন প্রকার ভারতের উত্তর কর্ণাটকের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় নাস্তা যা মেলা, উৎসব এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হতো। এটি চুরমুড়ি নামে ভারতের ব্যাঙ্গালোর এবং মাইসোরীয়দের কাছেও পরিচিত।
বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই জনপ্রিয় ঝালমুড়ি পাওয়া যায়। বিশেষ করে ঢাকার মধ্যে পুরান ঢাকার শাহী ঝালমুড়ি, নিউ মার্কেটের মুড়ি-ভর্তা, গুলিস্তানের ঝালমুড়ি, রায়ের বাজারের স্পেশাল ঝালমুড়ি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মামা-স্পেশাল ঝালমুড়ি বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া কুমিল্লার কোটবাড়ির খুশুনির বুট-মুড়ি, খুলনার সরকারি বি এল কলেজের আনোয়ার কাকার স্পেশাল চুই-রসুনে ঝালমুড়ি, খুলনা নিউ মার্কেটের ঝালমুড়ি; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজ্জাদ ভাইয়ের ঝালমুড়ি, রাজশাহী পাঠানপাড়া মুক্তমঞ্চের ঝালমুড়ি; পতেঙ্গার বিখ্যাত নুর কাকার ঝালমুড়ি; চট্টগ্রাম রোডের মসলা ঝালমুড়ি অন্যতম জনপ্রিয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাতেই এক বা একাধিক জনপ্রিয় ঝালমুড়িওয়ালাকে পাওয়া যায়।
ঝাল করে বানানো হয় বলেই এটির নাম হয়েছে ঝালমুড়ি। ঝালমুড়ির জন্য কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ছোলা, গাজর এবং শুকনো ভাজা চিনাবাদামের সংমিশ্রণ সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়া এর সাথে চানাচুর এবং বিভিন্ন মশলার সংমিশ্রণ করা হয় স্বাদ বর্ধনের জন্য। আবার অনেক জায়গায় বা রেস্তোরাঁয় স্পেশাল ঝালমুড়ি পাওয়া যায় যার দাম হয় একটু বেশি। বিভিন্ন মাংসও দেওয়া হয় অনেকসময়। পুরান ঢাকার মানুষ মাংস দেওয়া স্পেশাল ঝালমুড়ি পছন্দ করে। ঝালমুড়ি বাড়িতে সাধারণত প্লেটে করে চামচ বা হাত দিয়ে খাওয়া হয়ে থাকে। তবে বাহিরে ঝালমুড়িওয়ালা পরিবেশনকালে সাধারনত কাগজের তৈরি ঠোঙ্গা ব্যবহার করে। কাগজের ত্রিকোনাকৃতি একটা পাত্রে ঝালমুড়ি দেওয়া হয়। আর চামচ হিসেবে চারকোনা শক্ত কাগজ কেটে দেওয়া হয়। এছাড়া রেস্তোরাগুলোতে সাধারনত প্লেট এবং চামচ ব্যবহার করা হয়।
ঝালমুড়ি বিভিন্ন স্বাদ এবং বিভিন্নভাবে তৈরি করা যায় তবে উপকরনগুলো সাধারনত একই থাকে। প্রথমে একটি মাঝারি গামলায় পরিমানমতো মুড়ি, সিদ্ধ বুট এবং চানাচুর নিতে হয়। এর মধ্যে প্রয়োজনমতো পেঁয়াজ ও মরিচকুচি দেওয়া হয়, চাইলে ধনেপাতা কুচি করেও দেওয়া যেতে পারে । এবার পরিমাণ মত সরিষার তেল, বিট লবন বা খাবার লবন এবং লেবুর রস নিয়ে সবকিছুকে একসাথে ভালো করে মাখিয়ে বা ঝাকিয়ে তৈরি করা হয় ঝালমুড়ি।
স্বাদ বাড়ানোর জন্য চাইলে মাংসের ঝোলও ব্যবহার করতে পারেন। তাছাড়া আপনার পছন্দমতো টমেটো, পুদিনা পাতা, শসা বা গাজর ব্যবহার করতে পারেন । অনেকে বেশি ডাল দিয়ে খেতে পছন্দ করেন, আবার অনেকে কম ডাল পছন্দ করেন। সাধারনত বুট বা মটরশুঁটি ডাল সিদ্ধ করে দেওয়া হয়। একে ভারতে গুমনি বলা হয়। তাছাড়া রেসিপি অনুসারে ঝালমুড়ি মাখাতে আমচুড়, চাট মশলা, আদা বাঁটা, রসুন বাঁটা, হলুদ গুঁড়ো, টমেটো, গাজর, মটরশুঁটি, ধনে গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো, স্বিদ্ধ ছোলা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ পেতে। আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকারের ঝালমুড়ি পাওয়া যায়, যেমন- শাহী ঝালমুড়ি, মাংস ঝালমুড়ি, মুড়িভর্তা, চুই ঝালের ঝালমুড়ি, আস্ত রসুনের ঝালমুড়ি, ছোলা-মুড়ি প্রভৃতি।
কিছু কিছু খাবার বদলে দেয় দেশীয় সংস্কৃতির প্রচলন। স্থান পায় ভিনদেশি কোনো খাবার। ‘তোমরা আইসোরে, বাউল দাদার ঝালমুড়ির দোকানে, মুর্শিদের আদর্শে ঝালমুড়ি নিয়া দড়িয়াছি রে…।’ নিজের রচিত এমন অসংখ্য বাউল গান গেয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করে নিউইয়র্কপ্রবাসী বাঙালিদের আনন্দ দেন বাউল দাদা। ব্রিটিশদের ঝালমুড়ি উচ্চারণে কিছুটা সমস্যা হলেও তাদের কাছে রীতিমতো লোভনীয় খাবারে পরিণত হয়েছে এই ঝালমুড়ি। এখন ঝালমুড়ি লন্ডনের বিভিন্ন রাস্তায় ফুড ভ্যানে পাওয়া যায়। শুধু কি তাই, কেনার জন্য স্টলগুলোতে ভিড়ও থাকে চোখে পড়ার মতো।
বৃষ্টির দিনে ‘আজি ঝড়ো ঝড়ো মুখর বাদল দিনে’’ গান ছেড়ে চানাচুর, পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ কুচি করে সরিষার তেল দিয়ে মুড়িমাখা খাওয়া; শীতের সকালে সেই কাঁচাসোনা রোদে বসে মায়ের হাতে মাখানো সুস্বাদু মুড়িমাখা খেতে খেতে বাড়ির অন্য সবার সাথে আড্ডায় মেতে ওঠা যেনো এক টুকরো স্বর্গের সমান। বাঙালি খাদ্য সংস্কৃতির এক অতি জনপ্রিয় খাবার এই ঝালমুড়ি খায়না বা পছন্দ করে না এরকম মানুষের জুড়ি মেলা ভার। মুখরোচক এই খাবার একবার মুখে দিলেই ইচ্ছে হয় যেন খেতেই থাকি।