এই গরম গরম, ঘটিগরম!

by | জানু. 18, 2023 | Street Food

Traditional Khichuri hobe

Ghotigorom name came from an old process of making food delicious

শীত প্রায় শেষের দিকে। ধরুন সন্ধ্যে নামার মুখে জানালায় চায়ের কাপ হাতে বসে রয়েছেন আপনি। হঠাৎ কানে ভেসে এলো ঘুঙুরের শব্দ। বাংলার বুকে সন্ধ্যে নামা মানেই প্রতি গলির মুখে, মোড়ের মাথায় খুঁজে পাওয়া যায় নানা খাবারের পসরা। কি ভাবছেন?  কি বলছি আমি? একবার ঘুঙুরের কথা, একবার খাবারের কথা। বাংলার অলিতে গলিতে সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে ঘুঙুরের ছন্দে তাল মিলিয়ে যে ফেরিওয়ালারা হাজির হয় তারা হলো ঘটিগরমওয়ালারা। ঘটিগরম খেতে কে না ভালোবাসে। চানাচুর, ঝুরিভাজা, পোড়ানো ভুট্টা চিপস, পোড়ানো চিনাবাদাম, বিট লবন, পেঁয়াজকুচি, কাঁচামরিচকুচি, চাট মশলা, ঝালের গুঁড়ো, আমচুর, সর্ষের তেল আর সঙ্গে কাঁচা আম বা আমড়ার টুকরো- সব মিলিয়ে গরম গরম মুচমুচে খাবারটি যেন অমৃত। বিকেলে ঘুরতে বেরিয়ে টুকটাক মুখ চালাতে এর জুড়ি নেই।

‘ঘটিগরম’ নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জিভে জল আসা। ভোজন রসিক বাঙালিদের মধ্যে ঘটিগরম বেশ জনপ্রিয়। এই খাবারটির নাম ঘটি গরম হল কি করে এটাই ভাবছেন? আগেকার দিনে নানা মুখরোচক খাবার তৈরী করার জন্য নানা উপায় অবলম্বন করা হত। সেরকমই চানাচুর এমনিতে মুখরোচক হলেও সেটিকে আরও মুখরোচক বানানোর জন্য ঘটির মধ্যে কয়লা পুড়িয়ে সেখান দিয়ে আগুন প্রস্তুত করা হত এবং সেই ঘটির চারপাশে রাখা থাকত চানাচুর। সেই থেকেই এই খাবারটির নাম হয়েছে ঘটি গরম।

স্কুল-কলেজ, বাসস্টপ, পার্ক, মেলায় কিংবা সন্ধ্যায় শহরের অলিতে গলিতে ঘটি গরমওয়ালা একটি পরিচিত মুখ। টিনের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে, অদ্ভুত পোশাক পরে, চোঙাটুপি মাথায় দিয়ে, জোকারের মতো সেজে, মেলায় ঘুরে ঘুরে ঘটি গরমওয়ালারা চানাচুর বিক্রি করে আর গান গায়, “চানাচুর এনেছি, বড় মজাদার চানাচুর গরম, ঘটি গররররমমমম।” এই ঘটিগরম বিক্রেতাদের পোশাকে নানা ধরণ আছে। মুখে পাউডার, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে বের হন তারা। হলুদ আর লাল রঙের পোশাকটাও বেশ কিম্ভুতকিমাকার। মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলে ক্রেতা পাওয়া যায় ভালো, তাই এই বেশ ধারণ করেন তারা। সেই সঙ্গে চানাচুর খেতে আহ্বান জানানো বক্তব্যটাও আকর্ষণীয়। একটু টান দিয়ে হালকা সুরেলা ডাক উপেক্ষা করা কঠিন।

ফেরিওয়ালারা বিশেষ পদ্ধতিতে ঘটি গরম তৈরি করে। টিনের ভিতর চানাচুর থাকে ও চানাচুরের ভিতর বসানো থাকে আগুনসহ তামার ঘটি। চানাচুর গরম রাখার উদ্দেশ্যেই এ কৌশল অবলম্বন করা হয়। বিশেষ কায়দায় কৌটোর মধ্যে মিশিয়ে দেয় বিভিন্ন ঘটিগরমের উপাদান। কৌটোর মধ্যে মেখে নিয়ে দূরে আকাশে ছুঁড়ে দেয় কৌটো। তারপর হাতের নানান রকম কায়দা করে দিব্যি বলের ক্যাচ ধরার মতো ধরে নেয় ঘটিগরম এর কৌটো। আর ব্যাস একেবারেই তৈরি হয়ে যায় গরমাগরম ঘটিগরম। শেষে সকলের হাতে দেয় কাগজের ঠোঙায় করে। এই ঘটিগরমের মূল উপকরণ হল, মোটা ঝুরিভাজা ও তার সাথে মেশানো থাকে নানান উপাদান। 

একসময়ে অফিস ফেরত বাঙালির বিকেলের প্রিয় নাস্তা ছিল এই ঘটিগরম। সারা দিনের ক্লান্তি ভুলে মুখে স্বাদ আনত এই মুখরোচক খাবারটি। কুটিরশিল্পের কদর থাকলেও ঘটিগরমের পেশা বর্তমানে অবহেলিত, অসংগঠিত। অনেকেই আছেন যাদের কর্মজীবন শুরু এই চানাচুর বিক্রি করে। কিন্তু পরে তারা আরও লাভনীয় ব্যবসার সন্ধান পেয়ে চানাচুরের ঠোঙাটিকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তবে শুধু চানাচুর বেচে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, এমন দৃষ্টান্তও অঞ্চলভেদে দেখা যায়। ধীরে ধীরে এই পেশা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। লাভ কম পরিশ্রম বেশি, তারপর কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, সবকিছুই এর জন্য দায়ী।

পূর্ববর্তী ঘটিগরম শুধু তার নামের মাধ্যমে বেঁচে থাকলেও এখনকার ঘটিগরমের সাথে কোনো মিল নেই আগেকার ঘটিগরমের। তবু আজও সন্ধ্যে হলে বারান্দায় বসা ছোট্ট ছেলেটার কান এই ঘুঙুরের শব্দ শোনার জন্যই মুখিয়ে থাকে। কারণ আজও শহরের অলিতে গলিতে বড্ড জনপ্রিয় এই ঘটি গরম। হয়ত আর বেশিদিন আয়ু নেই এই পেশার, পরিবর্তী প্রজন্মের কাছে এগুলো গল্পকথা হয়ে থাকবে। লোকে তো কত কিছুকেই প্যাকেটবন্দি করছে আজকাল। কিন্তু ঘটি-গরমের কাছে সব প্যাকেজিং ঠান্ডা। আজও সে খোলা এবং ব্রান্ড ছাড়া। হারিয়ে যাওয়ার পথে হলেও হেরে যায়নি খাবারটি।

Related Post
তেলে ভাঁজা 

তেলে ভাঁজা 

ঢাকা একটি সমৃদ্ধশালী অর্থনীতির একটা শহর তেমনি ঢাকা একটি ব্যস্ত মহানগরও। এবং সুন্দর শহরের...

Subscribe To Our Newsletter

Subscribe To Our Newsletter

Join our mailing list to receive the latest news and updates from our team.

You have Successfully Subscribed!