অধুনা বাড়িতে রান্না খাবারের থেকে বাইরের খাবারের প্রতিই মানুষের ঝোঁক বেশি। কর্মব্যস্ততা ও সময়স্বল্পতা মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই তাড়াহুড়োই সব থেকে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি, পুষ্টিগুণ, তার সামঞ্জস্যতা বজায় রাখার ব্যাপারেই আমরা উদাসিন হয়ে পড়ছি। এক্ষেত্রে, রন্ধনশিল্পে কোন উপাদানটি কখন, কোথায়, কতটুকু, কত তাপে, কতক্ষণে দিতে হবে তার সঠিক মাত্রা একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শেফ নিশ্চিত করেন। আমাদের এই ব্যস্ততার কথা মাথায় রেখেই রান্না নিয়ে নিরিক্ষণের মাধ্যমে সুষম খাদ্য নিশ্চিতকল্পে একজন শেফের ভূমিকা অপরিসীম। এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা হচ্ছিলো বাংলাদেশের কিটো ডায়েট নিয়ে কাজ করা সনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘আরিফস ডায়েট’ এর এক্সিকিউটিভ শেফ কাজী আশিক ইকবালের সাথে। ‘দ্য ডাইনিভার্স’কে তিনি জানালেন, খাবারের ভিটামিন মিনারেল অক্ষুন্ন রেখে ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রা কমিয়ে সুস্বাদু ডায়েট নিশ্চিতকরণে তার অভিজ্ঞতা ও উদ্ভাবনের গল্প। সেই সঙ্গে খাদ্যনিরাপত্তা কঠোরভাবে নিশ্চেত করার জন্য তার নেওয়া কিছু ব্যক্তিগত পদক্ষেপের কথা।
ছোটবেলায় মায়ের রান্না দক্ষতায় অনুপ্রাণিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি বড় হয়ে রন্ধনশিল্পিই হবেন। সেই বাসনা থেকেই ২০০৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে। সেখানে বিশ্ববিখ্যাত ফ্রেন্স ইন্সটিটিউট ‘লা কর্ডন ব্লু’তে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই শিখতে শুরু করেন নানা রকম অনন্য সব খাবারের প্রিপারেশন।
২০০৫ সাল থেকে তিনি তার মেন্টর মি. গর্ডনের অধীনে সফলভাবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। সেখানে তিনি ২০০৭ সাল পর্যন্ত থাকেন এবং প্রতি সেমিস্টারে গড়ে ৭১ শতাংশ নম্বর ধরে রাখার কৃতিত্ব অর্জন করেন। ২০০৮ সালে কোর্সটি সম্পন্ন করে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন এবং বাংলাদেশের স্টেট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ ভর্তি হন। ২০১২ সালে মিরপুর ‘ইয়ানতাই চাইনিজ রেস্টুরেন্ট’-এ তিনি সহকারী শেফ হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে কর্মরত অবস্থায় রন্ধনশিল্পে বেশ সুনাম অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি বিশ্ববিখ্যাত চেইন হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট ‘লা মেরিডিয়ান’-এ অনকল শেফ হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ২০১৭ সালে ‘লা মেরিডিয়ান’ থেকে একটি স্বীকৃতি পাওয়ার পর ‘গ্লোরিয়া জিন্স’ এ জইন করেন এবং ২০১৯ সালে মালয়শিয়ান চেইন রেস্টুরেন্ট ‘সিক্রেট রেসিপি’তে সহকারী শেফ হিসেবে নিযুক্ত হন। সম্প্রতি তিনি ‘আরিফ’স ডায়েট’-এ এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন।
‘দ্য ডাইনিভার্স’র সঙ্গে তার কথোপকথনটি নিচে হুবুহু তুলে ধরা হলো:
১.বাংলাদেশে ডাইনবিডি এবং ‘দ্য ডাইনিভার্স’-এর উদ্যোগকে আপনি কেমন চোখে দেখছেন?
কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রেস্তোরার একটি ব্যুৎপত্তি লক্ষ করা গেছে। ট্রেন্ডে তাল মেলাতে বুঝে না বুঝে অনেকে রেস্তোরা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেছেন। সোশাল মিডিয়ায় বায়াসড প্রমোশনের এই যুগে সঠিক দিকনির্দেশনা ও অথেন্টিক তথ্যের উৎস হিসেবে এ উদ্যোগ যারপরনাই প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী। রেস্তোরা ব্যবসায়ের প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো ভোক্তার দারপ্রান্তে অবিকৃত অবস্থায় পৌছে দিতে এ উদ্যোগের জুড়ি নেই। সঠিক প্রশিক্ষণ ও যুগোপযোগী প্রচারণার সুন্দর একটি মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে এটি। এছাড়া ‘দ্য ডাইনিভার্স’ ম্যাগাজিনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের খাদ্যসংস্কৃতির সাথেও মানুষ পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাংলা খাদ্যও ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বপরিমন্ডলে। আমি এইটকে সাধুবাদ জানাই।
২. ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে আপনার দক্ষতার জায়গাগুলো সম্পর্কে একটু বলুন।
আমার সমস্ত ক্যারিয়ারে আমি এখনও পর্যন্ত ৫৫৪ টি রেসিপিতে সিদ্ধহস্ত হয়েছি এবং ৮ টিরও বেশি আন্তর্জাতিক কুইজিনে আমি সিদ্ধহস্ত। বাংলা, মেক্সিকান, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী, ইটালিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, চাইনজ, থাই, কন্টিনেন্টাল ও মাল্টি কুইজিনের অনেকগুরে ডিশ-এ আমার দক্ষতা রয়েছে। আমি এখনও নিজেকে শিক্ষার্থী মনে করি এবং প্রতিনিয়ত শিখে যাচ্ছি।
৩. আপনার আবিষ্কৃত অভিনব কিছু খাবার সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।
হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনারা জানেন যে স্বাস্থ্য সচেতনতার দিক দিয়ে কিটো ডায়েট হালের ট্রেন্ড। এই ডায়েটে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন, তারা রেজালা, রোস্ট বা মিষ্টিজাতীয় খাবার অথবা খুব বেশি তৈলাক্ত খাবার খেতে পারেন না। একই ধরনের খাবার মুখে এক ঘেয়ে হয়ে যায়। এই সমস্যা নিরসনে কিটো ডায়েট অনুসারীদের জন্য আমি উদ্ভাবন করেছি কিটো রেজালা, কিটো রোস্ট, কিটো সুইটমিট ইত্যাদি। এছাড়া চিরাচরিত খাবারের ভেতরে ক্রিমি স্যামন, লন্ডন ফিশ এন্ড চিপস ক্রিমি এন্ড ক্রিসপি, কোরিয়ান স্পাইসি সস ইত্যাদি খাবারেও আলাদা স্বাদ আনার চেষ্টা করেছি।
৪. আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
বাংলাদেশে বাবুর্চি এবং শেফ দুটো পেশাকে এখনও গুলিয়ে ফেলা হয়। যদিও দু’টোর কোনটাই কম সম্মানের নয়; কিন্তু এ পেশাগুলো বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে এখনও রয়ে গেছে অনেক সামাজিক বাঁধা-বিপত্তি। যারা এই পেশাতে আসতে ইচ্ছুক কিংবা কোর্স করে সঠিক প্রশিক্ষণের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের জন্য একটি কিচেন ওপেন করা যেখানে সকল প্রতিকূলতার উর্ধে উঠে সবাই শিখতে পারবে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে।
৫. সাধারণ জনগণের জন্য আপনার কোন বার্তা আছে?
হ্যাঁ, আমি সাধারণ জনগণের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলতে চাই নিজেরা স্বাস্থ্য সচেতন হবেন, ভালোমন্দ যাচাই-বাছাই করে খাবেন, উদার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলবেন; কোন কাজকেই ছোট করে দেখবেন না, খাবার নষ্ট করবেন না; আপনার অতিরিক্ত খাবার কোন অভুক্তের মুখে তুলে দিন। আসুন সকলে মিলে একটি ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলি।