বাঙালিরা খাবার পছন্দ করে, সে নতুন প্রজন্ম হোক বা আগের শতাব্দীর মানুষ। অনলাইন টিউটোরিয়ালের যুগে, অনেকেই সিদ্দিকা কবির সম্পর্কে জানতে নাও পারেন, তবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ বাড়ির রাধুনীদের একমত হতে হবে যে সিদ্দিকা কবির এমন একটি নাম যা অপরিবর্তনীয়। তিনি বাংলাদেশে একটি শিল্পের সূচনা করেছিলেন, যা হল রান্না। তার আগে, রান্না করা মহিলাদের জন্য একটি কর্তব্য এবং পুরুষদের জন্য একটি শখের কাজ ছিল। সিদ্দিকা কবির রান্নার ভাবনা এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন যে তিনি জাতির জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন।
সিদ্দিকা কবির ১৯৩৫ সালের ৭ মে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইডেন মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। পরে, তিনি বিভিন্ন সেক্টরে দুটি ডিগ্রি অর্জন করেন, একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এবং আরেকটি ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানে। তিনি ইডেন গার্লস কলেজে গণিত পড়ানোর মাধ্যমে তার পেশাগত জীবন শুরু করেন। পরে, তিনি হোম ইকোনমিক্স কলেজের পুষ্টি বিভাগে যোগদান করেন। তিনি একজন পুষ্টিবিদ এবং একজন রন্ধনশিল্পীর পাশাপাশি একজন জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপিকা ছিলেন। একজন গণিতবিদ থেকে একজন রন্ধন শিল্পী পর্যন্ত, তিনি জীবনের বিভিন্ন পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে রান্নার অনুষ্ঠানের পথিকৃৎ।
তিনি রান্নার বিষয়ে বিভিন্ন বই লিখেছেন, ‘রান্না খাদ্য পুষ্টি’ এবং ‘বাংলাদেশি কারি কুকবুক’ বাড়ির রান্নার মধ্যে খুব বিখ্যাত হয়েছিল। তার বই এবং টিভি অনুষ্ঠান অনেক গৃহিণীকে রান্না শিখিয়েছে। তিনি বাঙালি খাবারে নতুনসব মশলার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু, এটা সবসময় একটি সহজ কাজ ছিল না। সহজ ছিল না আইসক্রিম বা ব্রাউনি তৈরি করা কারণ তার কাছে পর্যাপ্ত উপাদান ছিল না। তিনি নতুন কিছু রান্না করেই প্রথমে তার পরিবারকে খাওয়াতেন। এতে তিনি তার রান্নার সঠিক প্রতিক্রিয়া পেতেন। এরপর তিনি তার রেসিপিগুলো লিখে রাখতেন।
ধীরে ধীরে, তিনি প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেছেন এবং তার নাগাল বাড়িয়েছেন। তার প্রথম টিভি অনুষ্ঠান ছিল ১৯৬৫ সালে। এটি পাকিস্তান টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়। এটি ছিল কোনো টেলিভিশনে প্রথম বাঙালি রান্নার অনুষ্ঠান। তিনি রাঁধুনি, ডানো এবং নেসলের মতো অনেক ব্র্যান্ডের জন্য কাজ করেছেন। সিদ্দিকা কবির তার কাজের জন্য অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। গৃহিণী ও বাবুর্চিদের কাছে সিদ্দিকা কবির শুধু একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি দেখিয়েছেন যে রান্না করা কেবল একটি কর্তব্য নয়, একটি শিল্প। তার অনুষ্ঠান ‘সিদ্দিকা কবিরের রেসিপি’ বাঙালির হৃদয়ে একটি বিশাল জায়গা তৈরি করেছে। এত বছর পরও আলোচনায় থাকে এই অনুষ্ঠান। সিদ্দিকা কবির এখনও মানুষের কাছে স্মরণীয় কারণ তিনি কখনই তার রেসিপিগুলো গোপন রাখেননি, তিনি সর্বদা তার সৃষ্টি ও গুন অন্যদের জানিয়েছেন। অনেক নতুন ও কমবয়সী রন্ধনশিল্পীরা তাদের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য তার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছে।
সিদ্দিকা কবির রান্নাকে শিল্প হিসেবে উপস্থাপন করার কয়েক দশক আগে, সাধারণ মানুষ জানত না যে এটি একটি পেশাগত আগ্রহ হতে পারে। এমনকি রান্নার ক্ষেত্রেও একটা বাঁধাধরা ধারণা ছিল যে রান্নাঘরে কাজ করা শুধুমাত্র মহিলাদের কাজ। সিদ্দিকা কবিরের সফলতার পর নারী-পুরুষ সমানভাবে রন্ধনশিল্প ও রন্ধনশিল্পীদের প্রশংসা করেন।
সাধারণ মানুষ তাদের বাড়ির রান্নাঘরের বাইরে পা রাখতে এবং অন্যদের কাছে তাদের রান্নার প্রতিভা দেখাতে অনুপ্রাণিত হয়। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও তিনি নারীদের অনুপ্রেরণা। তিনি সেই সময়ে সফল হয়েছিলেন যখন মহিলাদের জন্য কিছু করা ছিল খুব কঠিন। তিনি ১৯৭২ সালে বিয়ে করেছিলেন, এমনকি তার বিয়ের পরেও তিনি তার স্বপ্ন পূরণে পিছপা হননি এবং অন্যান্য অনেক নারীর পথ প্রদর্শক হয়েছিলেন।
সিদ্দিকা কবির একটি বিপ্লবী নাম, তিনি বাংলাদেশের সমাজের গদবাধা ধারণাকে ভেঙে দিয়ে সমাজে এবং মানুষের মনে গৃহিনী এবং শেফদের জন্য একটি সম্মানজনক স্থান তৈরি করেছিলেন। তিনি ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারী ঢাকায় মারা যান। বাংলাদেশ একজন কিংবদন্তীকে হারিয়েছে কিন্তু তিনি এখনও রন্ধনশিল্পের প্রতি অনুরাগী মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন।