উচ্চশিক্ষার নিতে আমাকে চীনে পাঠানোর জন্য আমি আমার মা বাবাকে প্রথমেই ধন্যবাদ দিতে চাই। আমার উচ্চশিক্ষার জন্য চীনে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিলো ভ্রমণ। আমি ভ্রমণ পছন্দ করি। এক একটি জায়গার নতুন ভাষা, পোশাক, ঐতিহ্য, উৎসব এবং নতুন খাবার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের অন্যতম সেরা উপায় হলো ভ্রমণ।
চাইনিজ রন্ধনপ্রণালী সমগ্র বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন রন্ধনপ্রণালীর একটি। হাজার বছরের পুরাতন সেই ঐতিহ্যে পা রেখে আমি আশ্চর্য হয়েছি প্রতি নিয়ত। তাদের এক একটি কৌশল, বেঁচে থাকার ধরণ, বিকশিত হবার প্রচেষ্টা যেন একেবারেই আলাদা রকম। কালের পরিক্রমায় ধরে রাখা তাদের পূর্ব পুরুষদের সকল উপহারই যেন তাদের কাছে গর্বের। তাই শুধু পরিচ্ছদ, চিকিৎসা, যন্ত্রপাতি দিয়েই থেমে নেই তাদের নতুন কিছু দেখানোর নেশা।
খাদ্য জগতে অকল্পনীয় সব পসরা নিয়ে শুরু থেকেই মাতিয়ে রেখেছে খাদ্যপ্রেমীদের মন। খাবারের রাজ্য হিসেবে চীনের খ্যাতি রয়েছে সর্বোত্র। এর অনন্য ভৌগোলিক পরিবেশ, স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য ও উপাদান, স্থানীয় রীতিনীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জাতিগত উত্তরাধিকার এবং কিছু জনপ্রিয় স্থানীয় খাঁটি স্বাদ চাইনিজ খাবারের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।
বেজিং পৌঁছানোর পর আমার কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হয়। আমার সেই বন্ধুরা নিজস্ব উদ্যোগে আমাকে চীনের সুস্বাদু খাবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলো। সেই মোতাবেক আমরা প্রথমে একটি রেঁস্তোরায় গিয়ে সকালের নাস্তাটা সেরে ফেলি। রেস্তোরাঁয় সাজানো খাবারের অভাব নেই। কিন্তু, বেশিরভাগই আমার অপরিচিত। সত্যি কথা বলতে আমার বান্ধবী সানজিন সেখানে না থাকলে খাবার কোনটা খাওয়া যায় এ নিয়ে দ্বিধার কোন সীমা থাকতো না। আমরা জিয়ান বিং (এক ধরনের চীনা প্যানকেক) এবং বাওজা (ভাপানো বান) অর্ডার করেছিলাম। জিয়ানবিং খুব সুস্বাদু একটি খাবার। উপকরণ হিসেবে এতে ব্যবহার করা হয় ময়দা, সয়া দুধ, চাইনিজ ব্ল্যাক বিন সস, তেল, চিলি পিপার সস, ২টি ডিম, পেঁয়াজ ও ২ টি ক্র্যাকারস। বাওজাতে রয়েছে ময়দা, চিনি, লবন। বাওজির ভেতরে পুর হিসেবে থাকে গ্রাউন্ড মিট (গরুর মাংস), স্প্রিং অনিওন, রসুন, সয়া সস, তেল এবং ব্লাক পিপার।
চীনের মহাপ্রাচীর:
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল ‘চীনের মহাপ্রাচীর’। মহাপ্রাচীরটি ২৩০০ বছরেরও বেশি পুরানো এবং সেখানে প্রতিদিন ১০ হাজার পর্যটক প্রাচীরটি পরিদর্শন করতে আসে। আমরা প্রায় ৪ ঘন্টা হাইকিং করেছিলাম। এরপর দুপুরের খাবারের জন্য একটি রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। হাইকিং-এর পর আমরা খুব ক্লান্ত ছিলাম। তাই খিদে পেটে সেসময়ের খাবারগুলো অসাধারণ লেগেছিলো। আমরা পিকিং হাঁস অর্ডার করেছিলাম। বেইজিং-এর এই হাঁসকে বলা হয় ‘চীনের সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার’। এটি মধ্যযুগীয় চীনে একটি রাজকীয় খাবার ছিল এবং ধীরে ধীরে পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের পছন্দের খাবার হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সাল থেকে প্রিমিয়ার ঝো এনলাই (চীনের প্রথম প্রিমিয়ার) বিদেশী অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য বেইজিং হাঁসকে একটি জাতীয় খাবার হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। একটি তাজা হাঁস কাঠ বা কাঠকয়লার আগুনের উপর গ্রিল করা হয় এই রেসিপিতে। রেসিপিটিতে উপকরণ হিসেবে রয়েছে হাঁস, হোয়েসিন সস, মাল্টোসা, চিনি, রসুন, আদা, সাদা গোলমরিচ, পাঁচমিশালি গুঁড়া, মধু, পানি, ভিনেগার, লেবু, সাইট্রাস খোসা, লিকোরিস, শসা এবং পেঁয়াজ। হাঁসের ডিশটি দেখতে খুবই রাজকীয় ও আকর্ষণীয় ছিল। এটার গন্ধ খুব ঝাঁজাল ও লোভনীয় ছিল, দূর থেকেই আমাদের নাকে ভেসে আসছিলো। এটা আমার জীবনে খাওয়া সেরা খাবারগুলোর ভেতর অন্যতম ছিল।
ফরবিডেন সিটি:
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল ‘ফরবিডেন সিটি’ । এটি চীনের অন্যতম সেরা ঐতিহাসিক স্থান। আমরা সেখানে পরিদর্শন করার পরে ‘দাশিলান স্ট্রিট’ এ গিয়েছিলাম। এটি ফরবিডেন সিটির ঠিক বাইরে। এটি বেইজিংয়ের একটি বিখ্যাত রাস্তা। আমি সত্যিই এই এলাকাটি অনেক উপভোগ করেছিলাম। ঐতিহ্যবাহী অনেক খাবার এবং কারুশিল্পের বেশ কিছু দোকান আছে এখানে। ফরবিডেন সিটি ঘুরে আসার পর আমরা ডিনারের জন্য একটি জমকালো শপিংমলে গিয়েছিলাম। সেখানে আমরা একটি হটপট রেস্টুরেন্টকে বেছে নিলাম রাতের খাবারটা সারবো বলে। হটপট এমন একটি চাইনিজ ডিনার যেটিকে আমি যদি স্কোর দেই তাহলে দশে দশই দিব। আপনারা অবশ্যই জীবনে একবার হলেও এই দারুণ মজার হটপট খেয়ে দেখবেন। হটপট একটি স্যুপ-ফুড বা স্টিমবোট নামেও পরিচিত, এটি একটি চাইনিজ রান্নার পদ্ধতি, খাবার টেবিলে স্যুপের স্টক সিদ্ধ করার পাত্রে দিয়ে পরিবেশন করা হয়, যাতে রয়েছে পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন ধরনের খাবারের উপাদান। আমরা স্লাইসড গরুর মাংস, ভেড়ার মাংস, মিটবল, স্লাইসড ফিশ ফিলেট, স্কুইড, কিমা করা চিংড়ি স্লাইড, স্প্রাউটস, মাশরুম, টোফু এবং নুডলস অর্ডার করেছিলাম। আমাদের ডিনার এক কথায় অসাধারণ ছিল।
এখন মাঝে মাঝেই আমার আফসোস হয় যদি আমি আরো কিছুটা সময় চায়নাতে থাকতে পারতাম, যদি সবকিছু আরো কিছুদিন উপলব্ধি করতে পারতাম, সেই সব জিনিস যা এখনো জানা হয়ে উঠেনি তবে বেশ ভালো হত। যদিও ঐ ভ্রমণ আমার শেষ ভ্রমণ নয়। আমি আবারও ভ্রমণে যেতে চাই অন্বেষণ করতে চাই। তবু সেদিনের উপভোগ করা খাবারগুলো আমার কাছে স্বরণীয় হয়ে থাকবে অনেকদিন।