“এক কাপ চা, সবাই মিলে খা”- ছোট বেলা থেকেই এই কথা লোকমুখে শুনে আমরা বড় হয়েছি। কত বার নিজেরাও বলেছি। প্রথম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের চুমুক এক নিমিষেই আমাদের সব ক্লান্তি দূর করে দেয়। এক কাপ চা আমাদের দিন শুরু করার একটি উপযুক্ত মাধ্যম। যেখানেই যাই এক কাপ চা আমাদের মাঝে থাকবেই। এই ধরুন- অফিস কিংবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা! চা কিন্তু আছেই সাথে। কিন্তু এই চা এল কোথা থেকে? এর উৎপত্তি হল কিভাবে? আর আমরাই বা পরিচিত হলাম কিভাবে? তা কখনও জানিনি কিংবা জানার চেস্টাও করিনি বটে!
বাংলাদেশসহ আরও প্রায় ৩০টি দেশে চা উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চায়না, শ্রীলঙ্কা এবং কেনিয়া। চায়ের চারা প্রথম উদ্ভাবন করেন রবার্ট ব্রুস ১৮৩৪ সালে। উনবিংশ শতাব্দীতে, সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় প্রথম এর চাষ করতে দেখা যায়। এরপর চায়না থেকে ধীরে ধীরে চারাগাছ আমদানি করা হয়। ১৮৫৪ সালে সিলেটের ‘মালনিছড়া’ তে প্রথম চা বাগান করা হয়। সেইখানে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। এরপর ১৯৬০ সালে এর ব্যপ্তি ঘটে লালচান্দ ও মাটিরাঙ্গাতে। এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে আমাদের চা শিল্প। এরপর বিস্তৃত হতে থাকে হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পঞ্চগড়ের মত বিভিন্নস্থানে। নানা রকমের বাঁধা বিপত্তি, ব্যবসায় মন্দা, বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েও আজ আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। বিংশ শতাব্দীতে সৈয়দ আব্দুল মজিদ, নওয়াব আমজাদ আলী খান, গোলাম রাব্বানি সহ ক্ষুদ্র ব্যাবসায়িরা তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। বাজারে তাদের নামও হয় বটে। কিন্তু এর পাশাপাশি আরও বড় বড় প্রতিষ্ঠান যেমন- ইস্পাহানী কোম্পানি, জেমস ফিনলে কোম্পানি ও ডানকান ব্রাদার্স বাংলাদেশ খুব খ্যাতি অর্জন করেছে।
চা আমাদের দেশের দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল। এর উৎপাদনের উপর আমাদের জিডিপি এর ১ শতাধিক আয় হয়। বর্তমানে চা রপ্তানিতে বাংলাদেশ অন্যতম। বর্তমানে আমরা দৃঢ় ভাবে চেস্টা করে যাচ্ছি কিভাবে এর আরো উন্নতি করা সম্ভব। চায়ের বাজারে যারা এখন সবচাইতে বেশী জনপ্রিয় তারা হল ইস্পাহানী কোম্পানি, কাজি অ্যান্ড কাজি কোম্পানি, আবুল খায়ের কোম্পানি, অরিয়ন কোম্পানি।
২০১২ সালে বাংলাদেশে চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিলো সবচেয়ে বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬৩.৮৫ লক্ষ কেজি চা উৎপাদন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। যার মুল্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো ২.৪০ মার্কিন ইউএসডলার। বাংলাদেশ শিল্পের দিক থেকে চা কে এগিয়ে রেখেছে বরাবরই, আর তাই বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে চা শিল্পের উন্নতির জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে করে পূর্ববর্তী সফলতা প্রতি পদক্ষেপে ধরে রাখা সম্ভব হয়। সিলেট বলতেই মানুষের মাথায় প্রথম চা এর নামটাই চলে আসে, সেই সিলেটের মৌলভীবাজারে বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বেশি চা বাগান রয়েছে। চা বাগান থেকে শুরু করে চায়ের যাবতীয় শিল্প সামগ্রী ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের দিকে থেকে আমরা এখন আর পিছিয়ে নেই।
এ বিষয়ে আমরা খুব দ্রুত না আগাতে পারলেও, ধীরে ধীরে অনেক উন্নতি সাধন করতে পেরেছি। আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত যে কোন শিল্পে প্রতিযোগীতা থাকাটা নতুন কিছু নয়। চা শিল্পের আন্তর্জাতি বাজারও তাই এর ব্যতিক্রম নয়। আমরা নানা রকম প্রতিযোগিতাকে পেছনে ফেলেআমনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি এবং এই প্রতিযোগীতা ক্রমাগত চলছে। বাজারভেদে বিভিন্ন কাঁচামালের মূল্য নির্ধারণ পরিবর্তনশীল। এরকম বাঁধার সম্মুখীন হয়েও বাংলাদেশ চা শিল্প কখনও পিছিয়ে থাকেনি।
বর্তমান বিশ্বে কত রকমের পানীয়ের উদ্ভাবন হয়েছে। কিন্তু কেউই চায়ের সাথে জয়ী হতে পারেনি। কেননা, চা এমন একটি পানীয় যা আমরা সর্বত্র পান করি। আমদের দেশে চা একটি আবেগের নাম। কোথাও আড্ডা জমাতে হলে আমরা চা কেই বেছে নেই সবার আগে। পছন্দের তালিকায় প্রথমেই থাকে এক কাপ চা। রঙ চা ধোঁয়া ওঠা গরম পানিতে লেবু আর চিনি দিয়ে, কখনো আদা বা অন্যান্য মসলার সমন্বয়ে উপভোগ করতে দারূণ। আর একটি অতি জনপ্রিয় চা হল দুধ চা। আর দুধ চা’য়ের জনপ্রিয়তার কথা নাই বা বললাম। অফিসের চাপ কিংবা পড়াশোনার চাপ সামলাতে পাশে থাকে এক কাপ চা। মন আর শরীর দুটোকেই প্রফুল্ল করে দেয় নিমিষেই। বর্তমানে স্বাস্থ্য সচেতনদের জন্য ‘গ্রীন টি’ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এছাড়াও এখন বিভিন্ন স্বাদের ইন্সট্যান্ট চা পাওয়া যায়। এটি সময় সাপেক্ষ হওয়াতে সকলের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত। যদি পছন্দ করার প্রশ্ন ওঠে সেখানে খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যে চা ভালোবাসে না। বরং দিনে কে কত কাপ চা খায় সে নিয়ে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যাবে।
এই যে আমরা এতক্ষন আমাদের চা শিল্পের ইতিহাস নিয়ে জানলাম, পাশাপাশি এর গল্পটা শুনলাম সবই খুব মনমুগ্ধকর। আজ আমরা চা শিল্পে যত উন্নত তার সবই পরিশ্রমের ফসল। ধৈর্য্য ধরে আমরা একটু একটু করে এগিয়ে আজ উন্নতির প্রায় শিখরে পৌঁছেছি। আমাদের এই পথ চলা গর্বের, আমদের এই পথ চলা আমাদের অহংকার। আমাদের চা শিল্প পৌঁছে যাক সমগ্র বিশ্বে, উন্নতির চরম পর্যায়ে এইটাই কাম্য।