সুস্থ শরীর ও সুস্থ মন হলো সকল সুখ ও সৌন্দর্যের উৎস। আর এই সুস্থ শরীর ও সুস্থ মনের জন্য চাই স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাবার। কথায় বলে, সুস্থ খাবার, সুস্থ জীবন’। এমন একটা সময় ছিলো যখন সুস্থ খাবার কিংবা নিরাপদ খাবার সম্পর্কে মানুষের কোন ভাববার প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু বর্তমানে যে কোন খাবার গ্রহণের আগেই ভাবতে হয় খাবারটি স্বাস্থ্যসম্মত তো? কিংবা নিরাপদ কিনা। নিরাপদ খাবার নিয়ে বর্তমানে সারা বিশ্বে চলছে আলোচনা আর আলোচনা। মূলত, স্বাস্থ্যসম্মত বা নিরাপদ খাদ্য বলতে আমরা বুঝি- ‘যে খাদ্য দেহের জন্য ক্ষতিকর নয়, দেহের বৃদ্ধি, ক্ষয় পূরণ ও রোগ প্রতিরোধ করে সেই খাদ্যই হলো স্বাস্থ্যসম্মত বা নিরাপদ খাদ্য।
বর্তমানে এই নিরাপদ খাদ্য মানুষের নাগালের বাইরে। সারাদেশে সব ধরনের খাবারে ভেজাল। ভেজাল খাবারের কারণে জনজীবন আতঙ্কে। ভাবতে অবাক লাগে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য যে ঔষধ, সেই ঔষধেও ভেজালের খবর জনজীবনকে আতঙ্কিত করে। এক সময় সন্তানদের পুষ্টিচাহিদা মেটানোর জন্য বিভন্নি ধরনের খাবারের পাশাপাশি নানা জাতের মৌসুম ফল খাওয়ানো হতো বা খাওয়ানোর পরামর্শ দিতো ডাক্তারেরা। কিন্তু, বর্তমানে যেকোন ফল এমনকি দেশী ফলেও নানা ধরনের মেডিসিন, ক্যামিক্যাল ব্যবহারের কারণে তা খাওয়ার অযোগ্য। শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের খাবারের ভেজাল আজ যেন অতি সাধারণ ঘটনা।
মাঝে মাঝে পত্রিকার পাতায় দেখা যায় নানা ধরনের ভেজাল খাদ্যের কারখানার খবর। জব্দ করা হয় মালামাল। কিন্তু, অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, কয়েকদিন গড়িয়ে গেলেই আবারও শুরু হয় পূর্বের মতো। ফলে ভেজাল খাদ্যের প্রসার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে সব ধরনের খাবারে ভেজালের আতঙ্কে মানুষ দিশেহারা। এমনকি বাজারের কাঁচা তরকারি, শাক-সবজি, মাছ সবকিছুতেই ভেজাল। এই ভেজাল খাদ্যের কারণে সচেতন মানুষের আজ তাদের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের খাবার।
একসময় দেশি অনেক ফলসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার থেকে মানুষের পুষ্টিচাহিদা পূরণ হতো কিন্তু সেসব খাবারও আজ ভেজালের কবলে। গোটা বিশ্বের পরিসংখ্যান হলো ৬৬০ মিলিয়নের বেশি মানুষ ভেজাল খাদ্যের নেতিবাচক প্রভাবের সন্মুখীন। সমগ্র বিশ্বে ভেজাল খাদ্যের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিদিন প্রায় চার লাখের বেশী মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভেজাল খাদ্যের উৎপাদন ও সরবরাহে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। মহাখালী পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের খাদ্য পরীক্ষাগারের তথ্যানুযায়ী দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যই ভেজাল এবং তা মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই ক্ষতিকর খাবার প্রতিনিয়ত আমরা গ্রহন করছি। ফলে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের গবেষণা অনুযায়ী ভেজাল খাদ্য গ্রহনের ফলে দেশে প্রতিবছর প্রায় তিন লক্ষ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে শুধু তাই নয় দেড় লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে এবং কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লক্ষ। এছাড়াও মানুষের দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের জটিল রোগ। এই যদি হয় ভেজাল খাদ্যের পরিণতি তাহলে সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকাটা কোন ভাবেই সম্ভব না। যে কারণে ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহন অতিজরুরী।
নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির জন্য ২০১৩ সালে দেশে আইন করা হয়েছে। ২০১৫ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলায় এবং বিভাগীয় শহরের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিরাপদ খাদ্য আদালত।
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য মানুষকে সচেতন করার জন্য সরকারি বেসরকারিভাবে কাজ করছে বিভিন্ন সংগঠন। নিরাপদ খাদ্য আইন মেনে চলার জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে; তবুও প্রতিনিয়ত যেন বেড়েই চলেছে ভেজাল খাদ্যের সরবরাহ।
একদল অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের খাবারে ভেজাল দিয়েই যাচ্ছে। যা সত্যি আতঙ্কের বিষয়। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে মানুষের স্বাভাবিক জীবন হবে দুর্বিষহ; যে কারণে ভেজাল বিরোধী অভিযান কঠোর করতে হবে, মানুষের সচেতন হতে হবে, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বো”চ শাস্তি মৃত্যদন্ডের বিধান এবং ১৪ বছরের কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এসব আইনগুলো যথাযথ প্রয়োগ জরুরী। মানুষকে সুস্থ থাকতে হলে নিরাপদ খাবার বিশেষভাবে প্রয়োজন।