প্রাণীজগতের সৃষ্টির সাথে সাথেই যে বিষয়টি এক ও অদ্বিতীয় হয়ে দাঁড়ায় তা হচ্ছে খাদ্যান্বেষণ। প্রতিনিয়ত টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে প্রাণধারন করাই তাই সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, তৈরী হয় খাদ্য-শৃঙ্খল এর। নিত্যচলমান এই প্রক্রিয়ায় মানুষের অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি খাদ্য-শৃঙ্খল প্রক্রিয়ার ভারসাম্যতা বজায় রাখার মূল উদ্দেশ্যও মানবজাতীর অস্তিত্ব রক্ষা।
খাদ্যগ্রহণে মানুষ চিরকাল সর্বভুক পর্যায়ের। আমিষ বা নিরামিষের চিন্তা না করেই সর্বোচ্চ প্রতিকূলতায় নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এমন কোন খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতি নেই যার ব্যবহার সে করেনি।
বিজ্ঞানমতে আদিমযুগে মানুষের যতগুলো প্রজাতি ছিলো তাদের ভেতরে আধিপত্য গ্রহণের ঝোঁক সব থেকে বেশি ছিলো আজকের এই হোমো-স্যাপিয়েন্স প্রজাতিটির। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় শুধুমাত্র দু’টো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য নিজের অন্যান্য প্রজাতির ওপর নিষ্ঠুরতার খড়গ নামিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতে একটুও কুণ্ঠাবোধ হয়নি বর্তমানে টিকে থাকা মনুষ্য সম্প্রদায়টির। নিশ্চিতভাবেই, খাদ্যই সব অভ্যুত্থানের মূল।
বাংলাদেশ, আরও বিস্তারিত বললে দক্ষিণ-এশিয়ার এই অঞ্চলটিতে পটপরিবর্তনের ইতিহাস বেশ বৈচিত্র্যময়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিল্পকলা, পরিবেশ, কৃষি ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন এসেছে বারবার। তাই, চলমান আধুনিকতা খুব কম সময়েই রূপান্তরিত হয়ে ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে গেছে। এই পরিবর্তনে অবশ্য বৈশ্বিক প্রভাব অনস্বীকার্য। বাঙালির খাদ্যাভ্যাস নিয়ে একটা গর্ব আছে। বেশ পরিপাটি ব্যঞ্জনে সুস্বাদু উপাদানে সুন্দর অলংকরণে অতিথী আপ্যায়ণে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। ভোজনরসিক বাঙালির খাওয়া এবং খাওয়ানোর গল্প বেশ পুরনো। এ এক অতি আদিম ও গর্বের ঐতিহ্য।
বাঙালির পুরুষতান্ত্রিক সমাজে হেঁশেলের দায়িত্ব চিরকাল নারীদের ওপরেই পড়েছে। একান্নবর্তী পরিবারের বড় হাড়ি চাপাতে তাই বেশিরভাগ পরিবারেই দেখা যেত মাটির বিশালাকৃতির চুলা। শিল্পপ্রেমী বাঙালির শৈল্পিক ছাপ চুলা তৈরীতেও দেখা যেত। তিন-মাথা, পাঁচ-মাথা, উঁচু-নিচু, দুইমুখো, তিনমুখো আরো কত কি। জ্বালানী হিসেবে কাঠ, শুকনো পাতা, খড়, গবরের ঘুটো ব্যবহার চোখে পড়তো হরহামেশা। বাসনকোসনের ক্ষেত্রেও মাটির তৈরী জিনিসের অগ্রাধিকার ছিলো। তবে বিভিন্ন পার্বনে কাসা, পিতল এমনকি অ্যালুমিনিয়াম কম যেত না। নদীমাতৃক বাংলাদেশে ভেতো-বাঙালির আমিষের চাহিদার অধিকাংশই চিরকাল মিটেছে মাছে। তাই ইতিহাস ঐতিহ্যের অনেকখানি জায়গাজুড়ে ভাত আর মাছ বাঙালির নিজস্ব সম্পদ। মাছে-ভাতে বাঙালি ব্যাপারটি সেই আদিকাল থেকেই। শাকসবজির বেলায় বনেবাদাড়ে গজিয়ে ওঠা নানান লতাপাতা, নিজের জমির ফসল আর বাড়ির উঠানেই গজিয়ে ওঠা মাঁচাভর্তি সবজিতেই মিটে যেত চাহিদা। রান্নাটা একটু চড়াঝালেই রাঁধতে দেখা যেত পরিবারগুলোতে। এর পেছনে অবশ্য একটা কারণও ছিলো। দরিদ্র পরিবারগুলো একান্নবর্তী পরিবারের সকলের মুখে অন্ন জোটাতে যেন অল্প ব্যঞ্জনে বেশটা খাবার খেতে পারা যায় তার একটা কৌশল বলা যেতে পারে এটাকে। সেক্ষেত্রে লবনের আধিক্যও পাওয়া যেত। ভর্তার উদ্ভাবনও এই ধারনা থেকেই বলা যায়। তবে গৃহস্থদের গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ, গোলাভরা ধানের গল্প ইতিহাস মনে রাখবে হাজার বছর।
এই একান্নবর্তী পরিবারের মায়া কাটিয়ে এক সময় মানুষ ছোট ছোট পরিবারে ভাগ হয়ে যেতে শুরু করলো। খাবারেও পরিবর্তন এলো খানিকটা। অবহেলিত রান্নাঘরের বড় চুলা ছোটতে পরিণত হলো। তবে হাড়ি কড়াই যাতে টেকসই হয় সেদিকে দেওয়া হলো নজর। জ্বালানীর ব্যবহারে তখনও মানুষ অভ্যস্ত সেই কাঠখড়ির ওপর। তবে, আমিষের ঘাটতি পূরণে মাছের কাতারে পাল্লা দিতে শুরু করলো মাংস। ছোট পরিবারের খাবার তালিকায় জায়গা করে নিলো পরিমানে কম হলেও একটু দাম দিয়ে কেনা বাজার সদাই। রান্নায় তখনও ঘরোয়া পরিবেশের চিরচেনা স্বাদ।
ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে শহরমূখী হতে শুরু করলো মানুষ। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে শুরু করলো শহুরে পরিবেশে। সে অভ্যাসের প্রভাব খাবারের ওপরেও যেয়ে পড়লো। স্বল্প আয়ের চাকুরিজীবি পরিবার ভাবতে শুরু করলো কম খরচে বেশি উপকরণ কিভাবে পাওয়া যায়। উপচে পড়া জনসংখ্যার খাবারের চাহিদা মেটাতে হাইব্রিডের একটি চর্চা শুরু হয়ে গেলো। স্বাদে যেমন তেমন প্রচুর ফলন আছে তাতে। নয়টা পাঁচটা অফিসের চাপ আর বাচ্চাদের স্কুলের সময়ে পুষ্টিচাহিদা মেটাতে টিফিনবক্স ভর্তি খাবার বহন করা বেশ নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়ালো। তবে, একঘেয়েমি কাটাতে কেনা খাবার বা মাসে অন্তর একবার রেস্তোরাঁয় যেয়ে সময় কাটিয়ে আসাটা স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। স্বাস্থ্যসচেতনতা দেখা দিলো মানুষের মাঝে। ভেজাল খাবারকে আলাদা করে কতটা নিয়ম মেনে খাওয়া যেতে পারে তার একটা প্রবণতা তৈরী হলো। ততদিনে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে সেই মাটির গন্ধমাখা সবুজ ফসল, বিশালাকারের তাজা মাছ আর কালো গাইয়ের ঘন দুধের গর্ব।
খাদ্যাভ্যাসে এবার প্রভাব পড়লো কর্মব্যস্ত মানুষের সময়ের অভাব। স্বামী-স্ত্রীর দুজনের ছুটে চলা, বাচ্চা মানুষ করতে হিমসিম খাওয়া মানুষ তখন রান্নার সময়টা বের করতে হাপিয়ে ওঠে। প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে ওদিকে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে চলেছে রেস্তোরাঁ। কি পাচ্ছেন না আপনি সেখানে! বাঙালি খাবারের পাশাপাশি মানুষের আগ্রহ যেয়ে পড়লো নানা দেশের খাবার চেখে দেখার প্রতি। খাবারের প্রতিটি পর্যায়ে নতুনত্বের ছোঁয়া দেখা দিলো। বিজ্ঞানের নানান ব্যবহার স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সমতার যুগে এসে রান্নাঘরের জায়গা দখল করে নিলো পুরুষ। তখন আর রান্নঘরটি ঢাকা পড়ে রইলো না শুকনো পাতা আর পাটখড়িতে। গ্যাস, বিদ্যুৎ আর বিজ্ঞান মানুষকে নিয়ে এলো ধোঁয়াছাড়া রান্নাঘরে। রাঁধুনীদের মাঝে তখন কম সময়ে বেশি স্বাদযুক্ত খাবার তৈরীর প্রতিযোগীতা। পরবর্তীতে কোভিড-১৯ এর মত মহামারী মানুষকে শিখিয়ে দিলো সর্বোচ্চ টেকনোলজির ব্যবহার। এলো ঘরে বসে অনলাইনের মাধ্যমেই হাতে পেয়ে যাওয়া খাবারের যুগ। যেন আলাদিনের দৈত্যকে তলব করে বলা ‘আমার এখন এই খাবারটি চাই’, আর সঙ্গে সঙ্গেই তা হাজির।
ক্রমপরিবর্তনশীল জীবনযাত্রায় মানুষের খাদ্যাভ্যাসে এসেছে পরিবর্তন। ভেজাল আর হালালের প্রতিযোগীতায় অসমভাবে বেড়ে চলেছে খাদ্যের প্রাচুর্যতার অন্বেষণ। এই ইঁদুর দৌড়ে হারিয়ে গেছে প্রাকৃতিক পুষ্টিগুণ ও খাদ্যমান। ঢেঁকিছাটা চাল বিলুপ্তপ্রায় রাইসমিলের চাপে। কমেছে মানুষের গড় আয়ু, বেড়েছে কিটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রকম জটিল রোগ। সব ছাপিয়ে আঁতিপাতি করে মানুষ খুঁজে চলেছে জৈবিক সারে উৎপাদিত খাদ্যের উৎস। শিশামুক্ত বাতাসে প্রাণভরে একটুখানি নিঃশ্বাস নেবার জন্য দিগবিদ্বিক ছুটে বেড়াচ্ছে। সবকিছুর ওপরে উঠে সবাই এখন বাঁচার চেষ্টায়। সচেতনতা বেড়েছে, কিন্তু সর্বদূষণের এই যুগে কতটুকু ভালো থাকা যাচ্ছে সেটি প্রশ্নবিদ্ধ। প্রকৃতির সান্নিদ্ধে যাওয়ার চর্চা করতে হবে। সব শেষে মনে রাখতে হবে সেই রেড ইন্ডিয়ান বিখ্যাত উক্তিটি,
“যেদিন পৃথিবীর শেষ গাছটি কেটে ফেলা হয়ে,
শেষ মাছটি ধরে ফেলা হবে,
শেষ নদীর জলও বিষাক্ত করে ফেলা হবে,
কেবল সেদিনই মানুষ বুঝবে,
টাকা খেয়ে বেঁচে থাকা যায় না।”