খেতে কে না ভালোবাসে বলুন? আর তা যদি হয় আপনার প্রিয় রেস্তোরাঁর খাবার, তাহলে তো কোন কথাই নেই। কিন্তু সমস্যাটা দেখা দেয় যখন আপনার ব্যস্ত জীবনের জন্য রেস্তোরাঁয় যাওয়ার সময় থাকে না। অথবা হয়তো আপনি আপনার পরিবারের সাথে অলস ছুটির সময়টা উপভোগ করাটা বন্ধ করতে চাইছেন না। যেটাই হোক না কেন সময় অপচয় না করে অথবা আপনার রান্নাঘরটিকে নোংরা না করে আপনার পছন্দের রেস্তোরাঁর খাবার খাওয়াটা দারুণ উপভোগ্য বিষয়। এখানেই আসে মানবতার সবচেয়ে বড় সমাধানটি; আপনার মুঠোফোনটি খুলুন এবং অনলাইনে কিছু খাবার অর্ডার করুন। এটা কতই না সহজ এবং মজাদার ব্যাপার, তাই না? যেন প্রযুক্তি আপনার নখদর্পণে আপনার খাবার আহ্বান করার ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আসলে ক্রেতার কাছে খাদ্য সরবরাহ করা একটি অতি প্রাচীন ধারণা যা প্রাচীন রোম থেকে চলে আসছে। বিশ্বাস করুন বা না করুন, ক্রেতার কাছে খাদ্য সরবরাহের উৎপত্তি প্রাচীন রোম থেকে! রোমানরাই প্রথম ক্রেতার কাছে খাদ্য পৌঁছে দেবার ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করেছিল যেমনটি আমরা আজ দেখে থাকি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রত্নতাত্ত্বিকরা পুরাতন পম্পেই নগরীতে ৮০টির বেশি টি-থার্মোপোলিয়ামের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। থার্মোপোলিয়াম ছিল একধরণের মাটির বিশাল পাত্র যা খাবার গরম রাখার জন্য রোমানরা ব্যবহার করতো, যাতে তারা খাবার স্থানান্তর করতে পারে। এখনকার সময়ে ঠিক এভাবেই ফাস্ট-ফুড আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। হয়তো প্রাচীন রোমানরা তাদের পছন্দের খাবার অনলাইনে অর্ডার করতে পারেনি, কিন্তু এটিই ছিল শুরু।
এখন বলুন তো, সর্বপ্রথম নথিভুক্ত সরবরাহকৃত খাবার ছিল কোনটি? যদি আপনার উত্তর হয় পিৎজা, তাহলে আপনার উত্তরটি সঠিক। ধারণা করা হয় সর্বপ্রথম নথিভুক্ত খাদ্য সরবরাহের ঘটনাটি ঘটে ১৮৮৯ সালে ইতালির নেপলসে। রাজা প্রথম উম্বার্তো এবং সেভয়ের রানী মার্গেরিতা যখন নেপলসে ছিলেন তখন তারা গণমানুষের জনপ্রিয় খাবার বিখ্যাত পিৎজা প্রস্তুতকারক রাফায়েল এসপোসিতোর সুস্বাদু পিৎজা খেতে চেয়েছিলেন। রাণী তার পিৎজা পছন্দ করেছিলেন এবং বিশেষ করে একরকম পিৎজা তার অত্যধিক পছন্দ হয়েছিল, যেটা ছিল মোজারেলা পনির, টমেটো এবং তাজা তুলসী পাতা দিয়ে বানানো আলা-মোজারেলা পিৎজা । এসপোসিতো রাণীর নামানুসারে এই পিৎজার নামকরণ করেছেন পিৎজা মার্গেরিতা নামে।
উনিশ শতকের শেষের দিকে, ব্রিটিশ শাসিত ভারতে জনবহুল বড় শহরে কর্মীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো, যা এই ব্যস্ত শ্রমিকদের খাবারের সমস্যা সমাধানের সাথে সাথে খাবার সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নের পথকে সহজ করে দিয়েছিল। এইসব খাদ্য সরবরাহকারী লোকেরা ডাব্বেওয়ালা (আক্ষরিক অর্থে “যিনি ডিব্বা বা পাত্র বহন করেন”) নামে পরিচিত ছিল। তারা বাড়ি এবং রেস্তোরাঁ থেকে গরম খাবার শ্রমিকদের কর্মস্থলে সরবরাহ করতেন।
১৯৫০ -এর দশকে যখন টেলিভিশন জনপ্রিয় হয়েছিল তখন লোকেরা রেস্তোরাঁয় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল এবং বেশিরভাগ পরিবার তাদের পছন্দের অনুষ্ঠান টেলিভিশনে দেখার সময় তাদের খাবার খেতে পছন্দ করত, এর ফলে রেস্তোরাঁগুলিতে গ্রাহকদের আনাগোনা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। তাদের প্রিয় খাদ্যরসিকদের এই নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে জিম্মি করা হয়েছে দেখে রেস্তোঁরা মালিকরা বুঝলেন যে তাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। ১৯৫০ -এর দশকে এভাবেই ফাস্ট-ফুড ডেলিভারি সার্ভিসের ধারণাটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আজকাল, আমরা অনলাইন ফুড ডেলিভারি সার্ভিসের ধারণার সাথে এতটাই পরিচিত যে, আমরা ভুলে যাই এটি সবসময় এরকম ছিল না। আপনি কি অনুমান করতে পারেন যে অনলাইন খাবারের প্রথম অর্ডার কি ছিল? পিৎজা হাট নব্বইয়ের দশকে পিৎজানেট চালু করেছিল। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কারণ তখন এটিই ছিল ইন্টারনেটে খাবার অর্ডার করার প্রথম ওয়েবসাইট। তাদের প্রথম অনলাইন খাবারের অর্ডার ছিল মাশরুম এবং অতিরিক্ত পনির সহকারে একটি বড় পেপারোনি পিৎজা।
১৯৯৫ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েটার’ বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনলাইন ফুড ডেলিভারি সার্ভিস শুরু করে। এখন এর নাম ওয়েটার ডট কম এবং এটি এখনও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ডোরড্যাশ, গ্রাবহাব এবং উবার ইটস্ বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ শিল্পের শতকরা ৮০ ভাগ নিজেদের দখলে রেখেছে।
আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বাংলাদেশও অনলাইন ফুড ডেলিভারি সেবার দৌড়ে যোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে ফুডপান্ডা, হাংরিনাকি, পাঠাও ফুড, সহজ ফুড, শেবা ফুড এবং খাস ফুড উল্লেখযোগ্য। যদিও বাংলাদেশের মানুষ এই ধরনের সেবার সাথে খুব বেশি অভ্যস্ত নয় এবং নেটিজেনদের মধ্যে ইন্টারনেটের গতি, অনলাইন ব্যবসার বিশ্বস্ততা ইত্যাদি বেশ কিছু জিনিস নিয়ে সমস্যা বিদ্যমান যা ফুড ডেলিভারি সেবা খাতের অন্তরায়; কিন্তু এটা দিন দিন বাড়ছে। এমনকি যারা ফুড ডেলিভারি পদ্ধতি সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না তারাও এখন এই খাতে কাজ করছেন। একটি ক্রমবর্ধমান শিল্প হিসাবে এসব বাঁধাগুলো খুবই স্বাভাবিক। হয়তো কয়েক বছর পরে বাংলাদেশের মানুষ এই সেবার সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়বে এবং তাদের সৃজনশীল চিন্তা দিয়ে এই সেবাতে আরো অনেক পরিবর্তন আনবে। সর্বপরি, এখনকার প্রতিটি চেষ্টাই খাদ্য সরবরাহ শিল্পকে নতুন আকার দেবে।
হাংরিনাকি বাংলাদেশে অনলাইন ফুড ডেলিভারি সেবার অগ্রদূত। তারা ২০১৩ সালের জুলাই মাসে তাদের যাত্রা শুরু করে। হাংরিনাকি এই মুহূর্তে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার এই ৫ টি শহরে কাজ করছে। এটি সারা দেশের এগারোশোর বেশি রেস্তোরাঁর খাবার তাদের সেবার মাধ্যমে সরবরাহ করে থাকে। এই স্টার্টআপটি ২০১৬ সালে বছরের সেরা স্টার্টআপ বিভাগে ডেইলি স্টার আইসিটি পুরস্কার লাভ করে। ফলস্বরূপ বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স ব্যবসায় অন্যতম নাম আলিবাবা ২০২১ সালে প্রায় ৮ কোটি টাকা দিয়ে হ্যাংরিনাকিকে কিনে নেয়।
বার্লিন ভিত্তিক ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান ডেলিভারি-হিরোর সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফুডপান্ডা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় সীমিত কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের যাত্রা শুরু করে। এমনকি হাংরিনাকির পরে কার্যক্রম শুরু করেও ফুডপান্ডা তাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে এবং এখন ফুড ডেলিভারি শিল্পে তারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কোন মুলধনের সমস্যা না থাকায় এবং একটি বহুজাতিক কোম্পানি হওয়ায় ফুডপান্ডা সুবিধা পেয়েছে। তারা তাদের এই সুযোগগুলো গ্রহণ করেছে এবং বাংলাদেশের অনলাইন ফুড ডেলিভারি শিল্পে এমন পরিবর্তন এনেছে যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
বাংলাদেশের অন্যান্য অনলাইন ফুড ডেলিভারি সেবাও দারুণভাবে ভাল করছে। প্রকৃতপক্ষে এই সমস্ত কোম্পানির কার্যক্রম বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার জন্য আমাদের আরেকটি নিবন্ধ প্রয়োজন। কারণ একটি ক্রমবর্ধমান শিল্পের অংশ হিসাবে তাদের প্রত্যেকে একই সমস্যা সমাধানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করছে। কিন্তু পরিশেষে তারা সবাই আমাদের জীবনকে সহজ করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করছে। হয়তো আর কিছু বছরের মধ্যে, তারা দেশের প্রতিটি স্থানে তাদের সেবা প্রদান করতে পারবে যাতে আপনি আপনার প্রিয় মানুষদের সাথে নিয়ে সময় কাটাতে কাটাতে আপনার প্রিয় খাবারগুলোর স্বাদ উপভোগ করতে পারেন।