যেকোন ব্যবসার পরিচালনা খরচ ব্যবসাটির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গুণমান ঠিক রেখে এই খরচকে যথাসম্ভব কমিয়ে আনা গেলে তা ব্যবসার জন্য উন্নতি বয়ে আনে। এই খরচ কমাতে পারলে কম খরচে ক্রেতাকে আরো বেশি সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয়। অন্যসব ব্যবসার মত খাবারের ব্যবসাতেও এই কথা প্রযোজ্য। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার পরিচালনা খরচের মধ্যে বড় একটি অংশ ব্যয় হয় রেস্টুরেন্টটি যেখানে অবস্থিত সেই জায়গার ভাড়া প্রদান করতে। একই মানের সেবা দিতে গেলে এই ভাড়ার উপর নির্ভর করে ব্যবসার খরচ বাড়ে বা কমে। সাধারণত জনসমাগম বেশি হয় এমন জায়গায় ব্যবসা করাটা ব্যবসার একটি কৌশল। এতে করে অধিক ক্রেতা পাবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু একইসাথে এমন জায়গা নিতে গেলে খরচও বেড়ে যায়। কেননা সবার কাছেই জায়গাটির গুরুত্ব বেশি থাকে। এই দুই বিপরীতমুখী স্রোতকে সামলিয়ে ব্যবসার অনুকূলে নিয়ে আসার চেষ্টা সবসময়ই ছিল। খাবারের ব্যবসায় এই সুবিধা নিয়ে আসে ‘ফুড কার্ট’।
‘ফুড কার্ট’ বলতে ভ্রাম্যমান খাবারের দোকানকে বোঝায়। এই দোকানগুলো স্থানান্তরিত করা যায়। ফলে সহজেই যেকোন জনবহুল জায়গায় এই দোকান নিয়ে ক্রেতাকে সেবা দেওয়া সম্ভব হয়। ‘ফুড কার্ট’ সাধারণত দুই ধরণের হয়ে থাকে। একটিতে বিক্রেতা খাবারের গাড়ির ভেতরে বসে ক্রেতাদের সেবা দেন। অন্যটিতে বিক্রেতা গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকেন, এক্ষেত্রে গাড়িটি শুধুমাত্র খাবার প্রস্তুত ও সংরক্ষন করার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ফুড কার্টের ইতিহাস অত্যন্ত পুরাতন। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে এমন ভ্রাম্যমান খাবারের গাড়ির উদ্ভব হয়। তখন গাড়িগুলোকে হাতে ঠেলে অথবা কোন পশু দিয়ে টেনে স্থানান্তর করা হতো। এতে করে খাবারের গাড়িগুলোকে বিভিন্ন জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত। রেলগাড়ির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ফুড কার্টের ইতিহাসকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যায়। তখনকার দিনে যেসব যাত্রীরা রেলে ভ্রমণ করতো তাদের খাবার ও পানীয়ের জন্য স্টেশনে রেলের নিজস্ব খাবার ব্যবস্থা থাকতো। কিন্তু তাদের মধ্যে নিম্ন আয়ের যাত্রীরা এই সুবিধা নেবার জন্য অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম ছিলনা। তখন রেল কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য কিছু ব্যবসায়ীকে ভ্রাম্যমান খাবারের গাড়ি নিয়ে স্টেশনে সেবা দেবার সুযোগ করে দেয়। এসব ফুড কার্টে কম খরচে খাবারের সুবিধা থাকায় নিম্ন আয়ের যাত্রীরা এই সেবা নিতে পছন্দ করতো। মূলত এভাবেই ফুড কার্ট সাধারণ মানুষের ভেতর জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার অনুন্নত দেশগুলোতে এখনো ফুড কার্টের মাধ্যমে যাত্রীদের খাবারের চাহিদা পূরণ করা হয়ে থাকে।
কালের পরিক্রমায় ইঞ্জিনচালিত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ফুড কার্টের ধরণেও পরিবর্তন আসে। এক্ষেত্রে পুরাতন ভ্যানগুলোকে ফুড কার্টে রূপান্তরিত করা হয়। ইঞ্জিনচালিত হওয়ায় এগুলোকে খুব সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেত। ভ্যানের পেছনের অংশটি খাবার রান্নার কাজে ব্যবহার করা হতো। কখনো কখনো বাসা থেকে খাবার রান্না করে দুপুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত অথবা কোন জনবহুল রাস্তার মোড়ে গাড়িগুলোকে নিয়ে গিয়ে ক্রেতাদের কাছে সেই খাবার গরম করে বিক্রি করা হতো। দোকান ভাড়া নেওয়ার কোন দরকার না থাকায় এসব ফুড ভ্যানগুলোতে কম মূল্যে ক্রেতাদের কাছে খাবার সরবরাহ করতে পারতো। ফলে অধিকাংশ ক্রেতাই এসব ভ্যানগুলো থেকে খাবার খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো।
আধুনিক ফুড কার্টগুলো আরো হালকা হতে শুরু করে। সাধারনত স্টিলের ফ্রেমে এসব কার্টগুলো বানানো হয়। এতে গ্রিল মেশিন, চিলার, ফ্রায়ার ইত্যাদি যুক্ত করা হয়। বিক্রেতা বাইরে দাঁড়িয়ে খাবার বিক্রি করেন। অনেক সময় কিছু হালকা চেয়ার দিয়ে ক্রেতাদের বসার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
আমাদের দেশেও ফুড কার্ট দিনদিন জনপ্রিয় হচ্ছে। এই ধরণের ব্যবসা আগে থেকেই চালু থাকলেও কিছু স্বপ্নবাজ মানুষের হাত ধরে নতুন করে আধুনিকভাবে উপ্সথাপিত হচ্ছে ফুড কার্ট ব্যবসা। পরিষ্কার-পরি”ছন্নতা, ভেজালমুক্ত আর স্বাস্থ্যকর এমনসব ধারণাকে আকড়ে ধরে ফুড কার্টে পরিবর্তন নিয়ে আসতে চাইছেন তারা। সিপি ফুড ট্রাক, মাটর্য, চপস্টিক, ইয়াম্মিলিসিয়াস, এইচএম ফুড, ফুড স্ট্রিট, স্প্যাগেটি হুইল, হটবক্স, ডিলাক্স স্ট্রিট ফুড, বোন এপ্যেটি এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ঢাকা যেন ফুড কার্টের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। ফুড কার্টের আধুনিকতায় সল্পমূল্যে ক্রেতাদেরকে সর্বোচ্চ সেবা দেবার যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তা যে সহসাই আরো বিশাল হবার অপেক্ষা করছে সেটা বলাই বাহুল্য।