ফুড বিজনেস ইয়ারবুক ২০২১

by | জানু. 21, 2023 | Blog

Traditional Khichuri hobe

In Bangladesh, Food Business is growing day by day.

২০২১ সালের পুরোটা জুড়েই অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মত বাংলাদেশের খাবারের ব্যবসায় বিভিন্নরকম উত্থান-পতন লক্ষ্য করা গেছে। গতবছরের করোনার ধকল কাটিয়ে এই বছরের শুরুটা যদিও অনেকটা আশার আলো দেখাতে শুরু করেছিল; কিন্তু মার্চের শুরু থেকে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় আবারো কঠোর লকডাউনে যায় পুরো দেশ। করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকায় এমনিতেই ক্রেতা সমাগম ছিল অনেক কম, এর উপর দফায় দফায় লকডাউন রেস্টুরেন্ট ব্যবসাকে খাদের কিনারে ঠেলে দেয়। যদিও রেস্টুরেন্টে বসে খাবার সুযোগ না থাকলেও খাবার কিনে নিয়ে যাবার সুযোগ ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র টেকআউটের উপর নির্ভরশীল হয়ে রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করা দিন দিন কঠিন হয়ে যায়। আমাদের চিরচেনা প্রথাগত হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসা মূলত টেকআউট নয় বরং ডাইন-ইন তথা রেস্টুরেন্টে বসে খাবার সুবিধা বিবেচনা করে নকশা করা। তাই খাবার বিক্রি করার সম্পূর্ণ নতুন ধরণের এই ব্যবসার ধাঁচের সাথে অনেকেই তাল মেলাতে পারেননি। বিক্রি কমলেও খরচ কমেনি তাদের।

ফলশ্রুতিতে খরচ কমানোর জন্য রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের ছাটাই করে টিকে থাকতে চেয়েছেন অনেকে। তবে দক্ষ শ্রমিক পাওয়াটা খুব কষ্টকর হওয়াতে অনেক রেস্টুরেন্ট মালিক শ্রমিকদের বেতন বন্ধ করে অথবা সল্প বেতন দিয়ে তাদের ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন, যা বাস্তবসম্মত নয়। তাছাড়া গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও দোকান ভাড়া দিতে না পারায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেক রেস্টুরেন্ট। ধারণা করা হয় ৩০ শতাংশের বেশি রেস্টুরেন্ট স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। সামনের দিনগুলিতে এই সংখ্যা আরো বাড়বে বলেই মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতে হোটেল-রেস্টুরেন্ট আছে ৬০ হাজারের বেশি এবং খাবারের ব্যবসার সাথে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা ২০ লাখের উপরে। তাছাড়া এই খাতের সাথে দেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। করোনা মহামারীতে এদের সবাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। তারপরও এই ব্যবসার সাথে জড়িতদের জন্য সরকারের তরফ থেকে বড় কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।

নামেমাত্র তালিকা হলেও আসেনি কোন সাহায্য। তার উপর যোগ হয়েছে হরেকরকম বিপত্তি। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার খাতকে শিল্প হিসেবে গণ্য না করায় এদেশের কোন রেস্টুরেন্ট শ্রমিক পরিচয়পত্র পান না। ফলে, যথাযথভাবে সাহায্যপ্রার্থীদের তালিকাটিই প্রস্তুত করা যায়নি। তাই চাকরি হারিয়ে বা বিনাবেতনে কাজ করে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের।

রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা ‘টেকআউট’ ধারনাটির সাথে মানিয়ে নিতে না পারলেও শুধুমাত্র এই ধারণাটিকে সামনে রেখে খাবারের ব্যবসাতে অনেক আগে থেকেই আরেকটি সেবা চালু আছে ‘ফুড হোম ডেলিভারি’ নামে। যাদের কাজ টেলিফোনে বা অনলাইনে অর্ডারকৃত খাবার ক্রেতার বাসায় পৌছে দেওয়া। আধুনিক জীবনে ব্যস্ততা বাড়াতে থাকায় অনেকের মন চাইলেই রেস্টুরেন্টে যাবার সুযোগ হয়ে ওঠেনা। সেক্ষেত্রে বাড়িতে বা অফিসে বসেই রেস্টুরেন্টের খাবারের স্বাদ নেবার চমৎকার একটি উপায় এই ফুড হোম ডেলিভারি সেবা। সারাবিশ্বে অনেক আগে থেকে এই সেবা চালু থাকলেও বাংলাদেশে এর যাত্রা শুরু হয় খুব স¤প্রতি। সর্বপ্রথম ‘হাংরিনাকি’ এদেশে ফুড ডেলিভারি সেবা চালু করে ২০১৩ সালে। এরপর একে একে ফুডপান্ডা, পাঠাও ফুড, উবার ইটস, সহজ ফুড, ইফুড সহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান এই খাতকে সমৃদ্ধ করে। সহজে এবং যখন ইচ্ছা তখনই রেস্টুরেন্টের খাবার উপভোগ করার এই ধারণাটি ইদানীং জনপ্রিয় হতে শুরু করেছিল বাংলাদেশে। এদেশে ব্যবসার বৃদ্ধি ধাপটি শেষ করে যখন এই সেবা পরিণত হতে শুরু করেছিল তখনই সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো করোনা মহামারি। অন্যসব ব্যবসা এই মহামারিতে ক্ষতির মুখে পড়লেও ‘ফুড হোম ডেলিভারি’ সেবার জন্য এটা ছিল আদর্শ সময়। বাংলাদেশে এমনিতেই এই সেবাটির পরিসর বাড়ছিল।

মহামারিতে মানুষের ঘরে থাকার প্রবণতা একে আরো জনপ্রিয় করে তোলে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান ফুড ডেলিভারি সেবাটি দিয়ে যাচ্ছে। এবছর ই-ক্যাবের তথ্য অনুসারে প্রতিদিন এসব প্লাটফর্ম ব্যবহার করে প্রায় লক্ষাধিক খাবারের পার্সেল ডেলিভারি হচ্ছে। প্রতিটি পার্সেলে গড়ে ৯৫০ টাকার অর্ডার করা হচ্ছে। দৈনিক প্রায় ৬ কোটি টাকার খাবার সরবরাহ করছে ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো। যা এই খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধিকে নিয়ে গেছে দুই হাজার কোটি টাকার উপরে। যদিও বছরের শেষ দিকে ফুড ডেলিভারি সেবার বর্তমান পথিকৃত ফুডপান্ডার সাড়ে ৩ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির মামলা কিছুটা অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে, কিন্তু এই সেবার পরিসর যে সামনে আরো বাড়বে বৈ কমবে না তা বলাই বাহুল্য। তবে ফুডপান্ডার ভ্যাট ফাঁকির মামলা বলে দিচ্ছে যে সামনের দিনগুলোতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এই খাতের নিয়ম শৃংখলা বজায় রাখার জন্য আরো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবে।

করোনা মহামারীর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশের খাবারের ব্যবসায় ‘ক্লাউড কিচেন’ নামক আরো একটি নতুন সেবা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই বাণিজ্যিক শব্দটি আমাদের সুপরিচিত না হলেও আমাদের অনেকেই না জেনেই এই সেবাটি নিয়ে কাজ করছেন ও সেবাটিকে উন্নত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

‘ক্লাউড কিচেন’ নিয়ে সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয় এটি হচ্ছে এমন একটি রেস্টুরেন্ট ব্যবস্থা যেখানে রেস্টুরেন্টের কোন বাস্তব অস্তিত্ব থাকে না। আমাদের প্রচলিত রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় খাবার খাওয়ার দুইটি ব্যবস্থা থাকে; একটি ডাইন-ইন বা রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া আর অন্যটি ডাইন-আউট বা খাবার পার্সেল করে বাসায় নিয়ে খাওয়া। ফুড হোম ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে এখন ডাইন-আউট সেবাটি যথেষ্ট জনপ্রিয় যা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এখন প্রচলিত রেস্টুরেন্ট ব্যবসা থেকে ডাইন-ইন অংশটি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ডাইন-আউট রাখলে যেটা দাঁড়ায় সেটিই হচ্ছে ‘ক্লাউড কিচেন’। এবার নিশ্চয়ই এই সেবাটিকে পরিচিত মনে হচ্ছে, তাই না? এই ব্যবস্থায় অর্ডারকৃত খাবার শুধুমাত্র নিজ প্রতিষ্ঠান অথবা কোন ফুড হোম ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রেতার বাসায় পৌছে দেওয়া হয়।

রেস্টুরেন্টের জন্য কোন জায়গা ভাড়া নিতে হয়না বিধায় ব্যবসা পরিচালনার খরচ সিংহভাগ কমে যায়। ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নারীরা অল্প বিনিয়োগে এই ব্যবসায় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা নিজেদের রান্নাঘরেই খাবার তৈরি করে নিজেরা অথবা ফুডপান্ডা বা হাংরিনাকির মত ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রেতার কাছে খাবার পৌছে দিচ্ছেন। এতে করে যেমন দেশের অনেক নারী ঘরে বসেই অর্থনীতিতে অবদান রাখতে শুরু করেছেন তেমনি ব্যবসার খরচ কম হওয়ায় ক্রেতারাও কমদামে ভালো খাবারের স্বাদ নিতে সক্ষম হচ্ছেন। বিশেষ করে কেক, পুডিং এবং সিঙ্গাড়া, সমুচা, পুরি, পেটিসের মত বিকেলের বিভিন্ন নাস্তাসামগ্রীর ক্ষেত্রে ‘ক্লাউড কিচেন’ এর উত্থান যথেষ্ট চোখে পড়ার মত। তাছাড়া ফেসবুকের মত সোশ্যাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে পেজ তৈরি করার মাধ্যমে তারা নিজেদের আলাদা সমর্থকগোষ্ঠি সৃষ্টি করতে সক্ষম হচ্ছেন। ২০১৯ সালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘ক্লুডিও’ বাংলাদেশে ‘ক্লাউড কিচেন’ সেবাটি নিয়ে আসলেও এটিকে জনপ্রিয় করতে বাংলার সাধারণ নারীদের অবদান অনস্বীকার্য।

বিশেষ করে করোনা মহামারীতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবারে আরেকটু আর্থিক সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে তারা প্রতিনিয়ত ‘ক্লাউড কিচেন’ এর উন্নতিতে সহযোগিতা করছেন। ২০২১ সালে ক্রমবর্ধমান ফুড-টেক ইন্ডাস্ট্রির কল্যানে আমরা ‘ক্লাউড কিচেন’ এর জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়তে দেখছি। সামনের দিনগুলোতে ফেসবুক পেজ নির্ভর ‘মেহজাবিন’স বেকারি’, ‘সুইট ডেইজি’, ‘স্বপ্নফেরি’, ‘প্রথমা কিচেন’ বা ‘জয়া’স বেক জয়’ এর মত ব্যক্তিগত ‘ক্লাউড কিচেন’ এর জায়গায় ‘ক্লুডিও’, ‘ঘোস্ট কিচেন’ বা ‘লিভ গ্রিন’ এর পাশাপাশি আরো বড় বড় ব্রান্ডের দেখা পাবো তা বলাই বাহুল্য। ইতিমধ্যে ‘ক্লুডিও’ ৫ লক্ষ ডলার বিদেশি বিনিয়োগ পেতে সক্ষম হয়েছে।

এ বছরের শুরুর দিকে খাবারের ব্যবসা তেমন ভালো অবস্থানে না থাকলেও বছরের শেষভাগে সংক্রমণের মাত্রা কমতে থাকায় করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবস্থা কাটানোর যথেষ্ঠ চেষ্টা চলছে। পরিবর্তিত জীবনধারায় প্রচলিত রেস্টুরেন্ট ব্যবস্থার পাশাপাশি ফুড-টেক নির্ভর ফুড হোম ডেলিভারি বা ক্লাউড কিচেনের উত্থান দেখছি আমরা। আশা করা যায় খুব তাড়াতাড়ি খাবার নির্ভর ব্যবসাগুলো মন্দাভাব কাটিয়ে আবার নিজস্ব গতিতে চলতে সক্ষম হবে।

Related Post
ফিফার জ্বর

ফিফার জ্বর

‘ফুটবল শুধু একটি খেলা নয়, এটি একটি আবেগ’- কথাটি প্রতিটি বিশ্বকাপেই সত্যি হয়। ‘ফুটবল’...

Subscribe To Our Newsletter

Subscribe To Our Newsletter

Join our mailing list to receive the latest news and updates from our team.

You have Successfully Subscribed!