কুয়াশার আস্তরণ কেটে সকালের সূর্য চোখ মেলেছে। তবে উত্তরে হাওয়ার যে কনকনে শীত, তা হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ঋতুবৈচিত্র্যের পালাক্রমে চলছে শীত। শীতকালীন খাদ্য তালিকায় প্রথমেই আসে মুখরোচক খেজুরের রস। কুয়াশা ঢাকা শীতের সকালে মিষ্টি রোদে বসে মধুবৃক্ষ থেকে আহৃত এক গ্লাস কাঁচা খেজুরের রস বাংলার মানুষকে সতেজ করে তোলে। আবার এই রস জ্বাল দিয়ে খেতে দারুন সুস্বাদু। এই রসে তৈরি দানা, ঝোলা ও নলেন গুড়ের স্বাদ ও ঘ্রাণই আলাদা।
যেমনি ফুটে উঠেছে কাজী নজরুলের ভাষায়-
“নতুন খেজুর রস এনেছি, মেটে কলস ভরে
ও আমার রস পিয়াসি রসিক জনের তরে
মিঠে রোদে শীতের দিনে, তরুণ বঁধু লও গো কিনে,
ফাগুন হাওয়া বইবে প্রাণে, ওগো হালকা নেশার ঘোরে।
মনিন মুখে দিয়ে দেখ, নলিন খেজুর গুড়
বাহির-ভিতর হবে তাহার, মিষ্টিতে ভরপুর, ওগো মিষ্টিতে ভরপুর।”
গ্রামীণ জীবনের প্রত্যাহিক উৎসব শুরু হতে যাচ্ছে খেজুরের মিষ্টি রসকে ঘিরে। শীতকাল আসলে বাড়ে অযত্নে ও অবহেলায় বেড়ে ওঠা এই খেজুর গাছের কদর। খেজুর গাছ মিষ্টি রস দেয়। আর এই রস থেকে তৈরি হয় গুড়। যার ঘ্রাণে মৌ মৌ হয়ে ওঠে পুরো এলাকার বাতাস।
আবহমানকাল থেকেই দেশবাসী ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’ প্রবচনটির সাথে পরিচিত। বৃহত্তর গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকা অর্থাৎ যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও খুলনা জেলায় বরাবরই খেজুর গাছ বেশি জন্মে। এক সময় অর্থক্রী ফসল বলতে খেজুর গুড়ের বেশ কদর ছিল। ধান উৎপাদনে জমির ব্যবহার ছিল স্বল্প। পরে থাকত দিগন্ত জোড়া মাঠ। আর সেখানে বিনা রোপন ও বিনা পরিচর্যায় বুনোলতার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠত খেজুর গাছ। তা থেকে রস বের করে তৈরি হত গুড়। এখনো খেজুরের গুড় উৎপাদনে বৃহত্তর যশোর শীর্ষে। খেজুরের রস নিয়ে বহু কবি কত শত কবিতা রচনা করেছেন। কবির ভাষায়,
“শীত এসেছে আমার বাড়ি
নিয়ে একটা রসের হাঁড়ি,
শীত এসেছে আমার দেশে
দেশটাকে ভাই ভালোবেসে,
শীত এসেছে পিঠা নিয়ে
খেজুরের রস মিঠা নিয়ে……।”
ব্রিটিশ আমলে খেজুর গুড় থেকেই তৈরি হত চিনি। এই চিনি ব্রাঊন সুগার নামে পরিচিত ছিলো। এই রস থেকে উন্নতমানের মদও তৈরি হত। চিনি ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হত। বিলেত থেকে সাহেবেরা দলে দলে বাংলাদেশে এসে চিনির কারখানা স্থাপন করে চিনির ব্যবসায় নামেন।
খেজুর শুষ্ক ও মরু অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়ায় গঙ্গার নিম্ন অববাহিকার খেজুর গাছে উতকৃষ্ট খেজুর হয় না। তাই এটি খাদ্য হিসেবে খুব একটা ব্যবহার হয় না।
বাংলাদেশের খেজুর গাছের প্রধান আকর্ষণ হলো খেজুরের রস। রস আহরণের জন্য খেজুর বা তাল গাছ কাঁটা ও গুড় তৈরিকারীদের দাকা হয় সিউলি বা গাছি নামে। হাড় কাপানো শীত উপেক্ষা করে ভোর রাত থেকেই গাছিরা রস সংগ্রহ করার কাজে বের হয়। শীতে খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে গাছ কাটেন গাছিরা। কখন, কিভাবে, কোথায় কেমন করে কাটতে হবে এবং যার ফলে গাছ মারা যাবে না; অথচ রস বেশি পাওয়া যাবে, তা একজন দক্ষ গাছিই ভালো জানেন।
খেজুরগাছ থেকে রস বের করার উপযোগী করে কাটা শুরু হয় হেমন্তের প্রথমেই। প্রথম গাছ কাটার পর দ্বিতীয়বার চাঁছ দিয়ে সেখানে বসানো হয় বিশেষভাবে তৈরি নলি। তার পাশে বাঁশের তৈরি ছোট শলাকা পোঁতা হয় ভাঁড় (কলস) টাঙানোর জন্য। চোখ বেয়ে নলি দিয়ে রস পড়ে ভাঁড়ে। খেজুরগাছ কাটা ও তা থেকে রস বের করার মধ্যেও কিছু কৌশল আছে। যে কেউ ভালো করে গাছ কাটতে কিংবা রস বের করতে পারেন না।
একবার গাছকাটার পর ২-৩ দিন পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা হয়। প্রথম দিনের রসকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় জিরেন। এ জিরেন রস স্বাদে ও মানে অনন্য। জিরেন রস দিয়ে তৈরি হয় উন্নত মানের গুড় ও পাটালি। দ্বিতীয় দিনের রসকে বলা হয় দোকাট এবং তৃতীয় দিনের রসকে বলা হয় তেকাট বা ওলা। যা দিয়ে তৈরি হয় ঝোল গুড়। রসের জন্য একবার কাটার পর ৫-৬ দিন বিরাম থাকে কাটা জায়গা শুকানোর জন্য। গাছ শুকানোর জন্য বছরে বছরে ঘুরিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে কাটা হয়। যাতে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে কাটা অংশে। শুকিয়ে গেলে আবার রস সংগ্রহ চলে। এভাবে একটি গাছ দৈনিক গড়ে ৮-১০ লিটার রস দিয়ে থাক। কথিত আছে, “খালি কলসি রেখে দিলে ভরে যায় রসে, সেই রসে দিয়ে জ্বাল মন ভরে সুবাসে”। আবার গাভীর সাথে তুলনায় বলা হয়, “মাইট্যা গোয়াল কাঠের গাই-বাছুর ছাড়া দুধ পাই”।
শীতের পিঠা-পায়েসের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান খেজুরের রস। খেজুরের রস ও পিঠার সাস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। রস দিয়ে হরেক রকম পিঠার ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। খেজুর পিঠা ও রসের নানা রেসিপি শিরনি-পায়েস, ঘনরসে চিতৈ পিঠা, খেজুর গুড়-নারকেল মিশ্রণে বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরি করা একটি শিল্প থেকে কম নয়। রসের সাথে জ্বাল দেয়ার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। খেজুরের ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়, ভেলি গুড়, বালুয়া গুড়, মিছরি গুড়, বেশ সুস্বাদু ও সুপরিচিত। গাছে নলি দেয়ার প্রথম দিকের রস থেকে তৈরি গুড়কে নলেন গুড় বলে। পাটালি গুড় ও কোচড় ভরা মুড়ি গ্রাম-বাংলার একটি পরিচিত দৃশ্য, খেতেও ভারি মজা। দুপুরে খেজুরের গুড়-মুড়ি আজকালের প্রজন্মের কাছে অচেনা এ মধুর স্মৃতি। এই গুড় দিয়ে হরেক রকম পিঠা বানায় গাঁয়ের বঁধুরা । ভাপা, সিদ্ধপুলি, মালপোয়া, লালুয়া, রসের চিতইয়ের মতো বহু রকম পিঠা। আর এই পিঠা বানানো ঘিরে শিশু-বৃদ্ধার বসে থাকার দৃশ্য বাংলার এক পুরোনো সংস্কৃতিরই অংশ। মনে হয় শীত যত বেশি, তাদের পিঠা খাওয়ার তৃপ্তি, আনন্দও তত বেশি। এরূপ দৃশ্যকে কবি সুফিয়া কামাল যেভাবে চিত্রায়িত করেছিলেন –
“পৌষ পর্বণে পিঠে খেতে বসে
খুশিতে বিষম খেয়ে।
বড় উল্লাস বাড়িয়াছে মনে
মায়ের বকুনি খেয়ে।”
খেজুরের গুড়ের চিনি সুমিষ্ট ও সুস্বাদু। খেজুরের রসের পাটালি গুড়েরও বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে বাংলার ঘরে ঘরে। গুড় বিক্রির অর্থনৈতিক উপযোগিতা রয়েছে। দেশের উৎপাদিত গুড় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইংল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরেও গুড়-পাটালির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
খেজুরের রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ, রয়েছে প্রচুর এনার্জি বা শক্তি। এতে জলীয় অংশও বেশি বলে এটাকে প্রাকৃতিক ‘এনার্জি ড্রিংক’ বলা যেতে পারে। এতে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকে। খেজুরের রস কাঁচা খাওয়া যায়, আবার জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করেও খাওয়া যায়। যাঁরা শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন, কাজকর্মে জোড় পান না, খেজুরের রস তাঁদের জন্য দারুণ উপকারী। রস ও গুড় দুটোই তারা খেতে পারবেন। খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড় অনিদ্রা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেজুরের গুড়ে আয়রন বা লৌহ বেশি থাকে এবং হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা খেজুরের রস এড়িয়ে যাবেন। এতে চিনির পরিমাণ বেশি।