ফল বলতে সাধারণত উদ্ভিদের বীজের সাথে যুক্ত হয়ে থাকা মাংসল অংশকে বোঝায় যা সাধারণত মিষ্টি বা টক স্বাদের হয়ে থাকে এবং কাঁচা অবস্থায় খাওয়া যায়; যেমন আপেল, কলা, আঙ্গুর, লেবু, কমলা, স্ট্রবেরি ইত্যাদি। এই অর্থে বলতে গেলে সাধারণত সবজি বলতে আমরা যা বুঝি তা প্রকৃতপক্ষে ফল হিসেবে গণ্য হবে; উদাহরণস্বরূপ বেগুন, মটরশুটি, ওকরা, এবং স্পষ্টতই টমেটোর কথা উল্লেখ করা যায়। তবে ১৮৯৩ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট একটি রুল পাস করে যে টমেটোকে ফল নয় বর সবজি হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা উচিত! প্রকৃতপক্ষে এই সিদ্ধান্তটি ফলের বিজ্ঞানগত অর্থকে পরিবর্তন করার জন্য নয়, বরং দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে সাধারণ অর্থে ফল এবং সবজির মধ্যে পার্থক্য করার জন্য দেওয়া হয়েছে। উদ্ভিদবিদ্যায়, একটি ফল হল সপুষ্পক উদ্ভিদের বীজ বহনকারী অংশ যা ফুল ফোটার পর ডিম্বাশয় থেকে গঠিত হয়।
রয়েল বোটানিক গার্ডেনের তথ্য অনুসারে, বিশ্বে মোট উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা আনুমানিক ৩৯০৯০০ টি। তাদের মধ্যে আবৃতবীজী উদ্ভিদের সংখ্যা প্রায় ২৫০০০০। উদ্ভিদবিদ্যা অনুসারে, ফল আসলে আবৃতবীজী উদ্ভিদের পরিপক্ক ডিম্বাশয়। তাই, বলা যায় যে আমাদের পৃথিবীতে প্রায় ২৫০০০০ প্রজাতির ফল রয়েছে। এটি খুব বড় একটি সংখ্যা। সুতরাং, এটি অনুমান করা খুব সহজ যে আমরা একটু খুজলেই একই বৈশিষ্ট্যমন্ডিত অনেক ফল পাবার সম্ভাবনা খুব বেশি। প্রকৃতপক্ষে, এমন অনেক ফল রয়েছে যাদের গঠন বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে দেখতে প্রায় একই রকম। আমরা এই নিবন্ধে ৫ টি টকস্বাদের লেবুজাতীয় ফল সম্পর্কে আলোচনা করব যেগুলো দেখতে প্রায় একই রকম।
টকস্বাদের লেবুজাতীয় ফল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং এগুলো ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। টকস্বাদের লেবুজাতীয় ফলগুলো ভিটামিন, খনিজ খাদ্যপ্রাণ এবং আঁশের একটি সমৃদ্ধ উৎস যা সামগ্রিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয়। টকস্বাদের লেবুজাতীয় ফলগুলো ভিটামিন সি-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। টকস্বাদের লেবুজাতীয় ফলের নাম সাইট্রিক অ্যাসিডের অ্যাসিড থেকে এসেছে। এই মৃদু অ্যাসিডটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দ্রবণীয় কঠিন পদার্থ। পানিতে দ্রবণীয়তা এবং পুষ্টিমানের জন্য টকস্বাদের লেবুজাতীয় ফলগুলো সাধারণত জুস শিল্পে খুব বেশি ব্যবহৃত হয়।
১.বাতাবিলেবু:
বাতাবিলেবু একটি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় টকস্বাদের লেবুজাতীয় ফল যা পাকলে সাধারণত ফ্যাকাশে সবুজ বা হলুদ রঙের হয়। এটিকে টকস্বাদের লেবুজাতীয় ফলের অকৃত্রিম প্রাকৃতিক প্রজাতির একটি হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। এটি সবচেয়ে বড় টকস্বাদের লেবুজাতীয় ফল যার মোটা ছাল এবং ফলের ভেতরে কিছু বীজ থাকে। বাতাবিলেবুর আকার একটি ফুটবলের মতো বড় হতে পারে এবং ওজন এক কিলোগ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। একারণে এটি উপাধি পেয়েছে – ‘সাইট্রাস ফলের রাজা’ হিসেবে। এর বৈজ্ঞানিক নাম হল সাইট্রাস ম্যাক্সিমা যা আক্ষরিক অর্থে অনুবাদ করলে হয় ‘সর্বশ্রেষ্ঠ টকস্বাদের লেবুজাতীয় ফল’। এর ভেতরের অংশ মিষ্টি কিন্তু চামড়া ও বাইরের ছাল তেতো। এর চামড়া প্রায়শই চকোলেটে ডুবিয়ে মোরব্বা বা মিছরি তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ১০০ সালের দিকে চীনে প্রথম বাতাবিলেবুর খোজ পাওয়া যায়। এর গাছগুলো ২০ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয় এবং ঝোপালো পাতা এবং সাদা ফুল তৈরি করে। জনশূন্য বনে, বাতাবিলেবুর ওজন ১০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। বাতাবিলেবুর গাছ উষ্ণ জলবায়ু এবং ভাল নিষ্কাশনযুক্ত মাটি পছন্দ করে। সাধারণত, নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে বাতাবিলেবু পরিপক্ক হয়ে থাকে।
২.সাইট্রন:
সাইট্রন হল একটি অকৃত্রিম টকস্বাদের লেবুজাতীয় ফল যেখান থেকে প্রাকৃতিকভাবে সংকর প্রজাতি বা কৃত্রিম সংকরায়নের মাধ্যমে অন্যান্য লেবুজাতীয় ফলের বিকাশ ঘটে। এই ফলটিও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। সাইট্রন সাধারণত উজ্জ্বল হলুদ রঙের হয়ে থাকে। এটি একটি অল্প বর্ধনশীল ছোট গাছ যা উচ্চতায় প্রায় ৮ থেকে ১৫ ফুট হয়ে থাকে। জনশূন্য বনে, সাইট্রনের ওজন ৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। সাইট্রন গাছ উষ্ণ জলবায়ু এবং ভাল নিষ্কাশনযুক্ত মাটি পছন্দ করে। সাধারণত, এটি শীত মৌসুমে পরিপক্ক হয়। এর ছালটি অত্যন্ত পুরু এবং ভেতরের অংশ তেমন রসালো নয়। সাইট্রনের একটি গভীর, শক্তিশালী এবং কড়া গন্ধ রয়েছে। এটি অনেকটা টক এবং তীব্র স্বাদযুক্ত। এই শুকনো ফলটি দক্ষিণ এশিয়ায় জ্যাম এবং আচার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম সাইট্রাস মেডিকা যা বিভিন্ন ঔষধি কাজে এর ব্যবহার স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে। সাইট্রন রক্তচাপকে স্থিতিশীল করে যা রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে এবং ধমনীর উপর চাপ কমায়। সাইট্রন জুস খেলে হৃদরোগ, এথেরোস্ক্লেরোসিস, স্ট্রোকের ঝুঁকি কম হয় এবং হৃদরোগের উপশম হয়।
৩.ছোট কমলালেবু
ম্যান্ডারিন কমলালেবু বা সাইট্রাস জাতীয় ফলের একটি ধরন।এটা সাইট্রাস রেটিকুলেট বৈজ্ঞানিক নামে পরিচিত। এগুলে ছোট ছোট সাইজের হয়ে থাকে, একেকটা প্রায় ৩০-৪০ মিলিমিটারের মতো। কোনটো হলুদাভ কমলা অথবা লালভ কমলা রংয়ের দেখা যায়। প্রায় সব ধরনের সাইট্রাস ফলের মধ্যে, এই ম্যান্ডারিন ই সবচেয়ে সহজে খোসা ছাড়ানো যায়, যার জন্য এটার জনপ্রিয়তা অনেক। এগুলোর কোনোটাতে বিচি থাকে আবার কোনোটা তে থাকে না। ম্যান্ডারিন গোটা ফল হিসেবে খায় অনেকে, ম্যান্ডারিন জুস এই গরম কালে খুবই জনপ্রিয় কারন এটি প্রচুর মিষ্টি হয় খেতে। প্রতি ১০০ গ্রাম ম্যান্ডারিন এ ২২৩ কিলোজুল এনার্জি, ১৩.৩৪ গ্রাম শর্করা, ১০.৫৪ গ্রাম গ্লুকোজ , ১.৮ গ্রাম ফাইবার, ০.৩১ গ্রাম ফ্যাট ও ০.৮১ গ্রাম আমিষ থাকে।এছাড়াও বিভিন্ন খনিজ ও ভিটামিন যেমন- এ,বি১, বি২,বি৩,,বি ৫,বি৬,বি৯,সি এবং ই থাকে।
৪. ট্যান্জেলো
ট্যান্জেলো অথবা হানিবেল, ছোট সাইজের কমলালেবু, যা একটি সংকরায়ন করা ফল,কমলালেবু ও বাতাবীলেবুর সংমিশ্রণ করে এই ফল উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটার বৈজ্ঞানিক নাম সাইট্রাস ট্যান্জেলো। এটি সাইজের বড়দের হাতের এক মুষ্টির সমান আর প্রচুর রসালো মাংসল যা খেতে একটু টক টক আবার মিষ্টি ও লাগে। এদের ডগায় বোটা দেখে এদের চেনা যায়। এতে প্রচুর ভিটামিন – সি থাকে এবং ব্যাথানাশক ও এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে বেশ ভালো ভূমিকা রাখে। একটি ১০০ গ্রাম ট্যান্জেলো ৪৭ গ্রাম ক্যালরি, ১.১ গ্রাম আমিষ এবং ১১.৬ গ্রাম শর্করা, ৯.৫ গ্রাম চিনি, ৫২.৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি ধারন করে।
৫. রক্ত কমলা
লাল রংয়ের মাংসল হওয়ার কারনেই এই কমলালেবু গুলো রক্ত কমলা নামে পরিচিত। যার কারন হলো এন্থোসায়ানিন পিগ মেন্ট। রক্ত কমলার প্রধান উপাদান ক্রিসএন্থেমিন। রক্ত কমলা প্রচুর সুস্বাদু, সেই সাথে ওজন কমাতে বেশ উপকারি, এছাড়াও অন্ত্র ভালো রাখতে, ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে। কারন এতে রয়েছে প্রচুর দরকারি ভিটামিন, খনিজ, ফাইবার এবং এ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ক্যান্সার, ডায়াবেটিস সহ বিভিন্ন হার্টের রোগের জন্য বেশ ফলপ্রসূ। রক্তকমলা খেতে কমলালেবুর মতো মিষ্টি, আঙ্গুরের মতো ট্যাংগি আর জামের মতো টক।