মেহমানখানা

by | জানু. 16, 2023 | Feature

Traditional Khichuri hobe

করোনা মহামারীর এক কালো মেঘের নিচে যখন মানুষের বেঁচে থাকাটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন সময় ঢাকা শহরের কাঁটাবনের গলিগুলোতে আটকে থাকা পশুপাখিদের ক্ষুধার চিৎকার কানে আসে এক দরদীর। পাখিরা কি খাবে এই মন্দার সময়, রাস্তার কুকুর বিড়ালেরা কি খাবে? ওদের ও তো ক্ষুধা লাগে, বলতে যে পারে না। রোজ তাই নিয়ম করে তাদের জন্য খাবার নিতে শুরু করে এই মানুষটি। নাম তার আসমা আক্তার লিজা।

এমনই এক নিয়ম করা দিনে পাখিদের খাবার টেবিল সাজাতে যেয়ে তার কানে আসে এক আওয়াজ। কোথাও যেন কেউ কিছু ভাঙছে। ঠিক তাই, ক্ষুধার তাড়নায় দুটি শিশু কোন এক খাবারের দোকান ভেঙ্গে মিটাতে চাইছে তাদের পেটের জ্বালা। ভাবতেই গাঁ শিওরে ওঠে তার। ‘আমি এতদিন মানুষের কথা ভাবিনি?’ এমনই এক আফসোসে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। ঘুরে দাঁড়ায় তার সকল চিন্তা চেতনা, শুরু হয় আজকের মেহমানখানা।

দুমুঠো অন্য যেন মানুষের মুখে সে তুলে দিতে পারে তার জন্য যুদ্ধ শুরু করে। একার পক্ষে কতই বা সম্ভব হয় এতকিছুর আয়োজন করা! দোকানে দোকানে বাকির খাতা যেন বাড়তে থাকে। অন্যদিকে অসহায় মানুষের শুকনো মুখগুলো যেন ঘুমাতে দেইনা লিজাকে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে দয়া-বৃক্ষের শাখা প্রশাখা। এগিয়ে আসে তরুণ প্রাণের ঝাঁক। বিনা স্বার্থে সকলে মিলে ভাগ করে নেই কাজ। কেউ কুটনা কাটে, কেউ বাটনা বাটে, কেউবা হাড়ি কড়াই বয়ে আনে। উদ্দেশ্য একটাই, চুলায় যেন আগুন জ্বলে, মানুষের পেটে নয়।

করোনাকালীন সময়ে দিনের পর দিন লকডাউনে বন্ধ পড়ে আছে সবকিছু। তাই বলে কি বন্ধ করে রাখা যায় পাক¯’লীর দরজা? সময় হলেই খাবলে ওঠে, খাবার চায়। স্বল্প-আয়ের অসহায় মানুষগুলো কাকে বলবে এই যন্ত্রণার কথা? তাইতো মেহমানখানায় আমন্ত্রিত সকলেই। তারা এখানকার প্রতিদিনের মেহমান। মানবতার ক্রান্তিলগ্নে এমন উদ্যোগ আসলেই আশা জাগানিয়া। বৈশ্বিক সংকটের মূহুর্তে সবার সাথে আহার ভাগ করে নেওয়ার এই প্রচেষ্টা যারপরনাই প্রশংসনীয়।

দিন বাড়ার সাথে সাথে মেহমানখানার মেহমান সংখ্যাও বাড়তে শুরু করলো। এক ডেকচি থেকে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ দেখতে দেখতে চার ডেকচিতে পৌঁছেছে এখন। ফলত, বেড়েছে খরচও। এসেছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। কিš‘ তাই বলে থেমে নেই মেহমানদারি। মানবোন্নয়নের এই মিছিলে দলে দলে সামিল হচ্ছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। সেবার এই মহত কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিইয়েছেন নাম গোপন রেখেই। কেউ কেউ অর্থবিত্তে পেরে না উঠলেও গায়ে-গতরে খেটে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই স্বপ্নতরী। এ যেন নুহ’র নতুন নৌকা। জাত-পাত, ধনী-গরীব, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে হাল ধরেছেন। আত্মকেন্দ্রিক এই কলিযুগে, সত্যযুগের আদর্শ প্রচারণার এমন প্রচেষ্টা আশা উদ্রেককারী।

One of the initiatives taken by Mehmankhana

এই মহতী উদ্যোগের উদ্যোক্তা আসমা আক্তার লিজাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, ‘মেহমানখানা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে কি?’ স্বাবলীলভাবে তিনি উত্তর দিলেন, ‘আপনি যদি বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কথা বলে থাকেন তবে তা কখনই নয়। কিš‘ একটা দাতব্য সংগঠন সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নেওয়া এবং এর সাথে জড়িত কর্মীদের সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদানের জন্য এবং একই সাথে বিভিন্ন রকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়ানোর জন্য মেহমানখানাকে এনজিও হিসেবে নিবন্ধিত করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ট্রান্সপারেন্সি নিয়ে যেন প্রশ্ন না ওঠে এবং উঠলেও সঠিক ব্যাখ্যা দলিলদস্তাবেজ আকারে আমাদের কাছে যেন থাকে সেই নিমিত্তেই আমাদের নিবন্ধিত হওয়াটা জরুরী।’

অভুক্ত পশুপাখিদের খাবার দেওয়ার আইডিয়া থেকে জন্ম নেওয়া এ উদ্যোগ আজ মেটাচ্ছে হাজারও ক্ষুধার্তের ক্ষুধা। এই উদ্যোগ এখনো ঢাকা কেন্দ্রিক। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় স্বে”ছাসেবী ক্ষুধা-সৈনিকদের এক একটি পল্টন যেন থাকে সেরকম একটি পরিকল্পনা মেহমানখানার রয়েছে। কালে কালে এমন উদ্যোগ অনেক দেখা গেলেও তাদের বর্ষনের চেয়ে গর্জন ছিলো অনেক বেশি। মেহমানখানা এর ব্যতিক্রম। এর প্রচারবিমূখতাই এর প্রধান শক্তি। যেটুকু যা প্রচারণার কাজ চলে তাও শুধু অভুক্তের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এমনকি, এ সংগঠনের দাতাগোষ্ঠীও স্বপ্রণোদিত হয়েই অবলীলায় করে যা”েছন মানবসেবা।

থেমে থাকেনি মেহমানখানা। তারুণ্যই যে সংগঠনের প্রধান চালিকাশক্তি বস্তুবাদের কষাঘাতে তার চাকায় জং ধরার নয়। নেই কোন নামজাদা কারিগর কিংবা দক্ষ বাবুর্চি, নেই পরিবেশন করার জন্য একঝাক বেয়ারা। কিন্ত যে জিনিসের কখনো কমতি পড়েনি তা হলে প্রাণচা ল্য। নিবেদিতপ্রাণ পুরোন স্বে”ছাসেবকদের পাশাপাশি প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন আরো প্রাণ। উদ্যেশ্য কেবল একটাই, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানবসেবায় নিজেদের উতসর্গ করা। এমনও সময় গিয়েছে এই স্বেচ্ছাসেবকেরা নিজেরা নিরন্ন থেকে খাবার তুলে দিয়েছেন অনাহারীর মুখে। নিজেদের হয়ত নেই এক টুকরো মাথা গোঁজার ঠাই, কিন্ত তাতে উতসাহে ভাটা পড়ে না। কাজ করে যাচ্ছেন নিরলস। এ যেন লংকা বিজয়ে কিস্কিন্দা সেনা।

উদ্যোক্তাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, ‘আপনাদের তেজারতের হিসাবকিতাব রাখা হয় কিভাবে?’ তার সোজা-সাপটা সরল জবাব, ‘আমরা আমাদের আয়ব্যায় উন্মুক্ত রেখেছি। যখন যেটুকু দরকার আমাদের কর্মীরাই স্ব-উদ্যোগে সেগুলো সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও বণ্টন করে থাকেন। এখানে সবাই সমান। নেই পদমর্যাদা সংক্রান্ত কোন জটিলতা। সেবাটাই যখন মূখ্য স্বার্থ সেখানে ত্যাজ্য। এখনো কোন কর্মীকাঠামো বিনির্মাণের প্রয়োজন পড়েনি, তবে মেহমানখানা এনজিও তে রুপান্তর হলে ব্যাবস্থাপনার স্বার্থে সেগুলো নিয়ে ভেবে দেখা যেতে পারে।’

সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিপার্শিক ও অবস্থানগত সকল প্রতিবন্ধকতার উর্ধে উঠে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে মেহমানখানা। বৈশ্বিক দূর্যোগের এই মুহুর্তে থমকে যাওয়া পৃথিবীর বেশকিছু ক্ষুধার্তমুখে তারা তুলে দিয়েছেন দু’মুঠো অন্ন। লালমাটিয়ার ডি ব্লক থেকে শুরু হওয়া এ উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ুক দেশের কোণায় কোণায়।

Related Post
বিয়ে বাড়ি

বিয়ে বাড়ি

‘বিয়েবাড়ি’ কথাটা শুনলেই চোখের সামনে ঝা চকচকে উৎসবমূখর পরিবেশ ভেসে ওঠে আর কানে বাজতে থাকে...

Subscribe To Our Newsletter

Subscribe To Our Newsletter

Join our mailing list to receive the latest news and updates from our team.

You have Successfully Subscribed!