একদা এক সন্ধ্যায়

by | জানু. 21, 2023 | Blog

Traditional Khichuri hobe

Consuming healthy snack makes people energetic

সারাদিনের মধ্যে সন্ধ্যার সময়টুকুই আমার কাছে সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত বলে মনে হয়। ক্লান্তিকর দিন শেষে পরিবারের সাথে আড্ডা দেওয়া, খেলাধুলা করা এবং অবশ্যই, ‘মায়ের হাতের তৈরি সুস্বাদু স্ন্যাকস!’ আর কী বা লাগে! আমরা চা এবং শুকনো কেকের স্বাদ ছাড়া কখনো একটি সন্ধ্যা এড়িয়ে যাইনি। মা সবসময় দুধ চা আর ফুল ক্রিম চা বানাতেন। আমি যখন বড় হয়ে চা বানাতে শিখলাম বিভিন্ন রকম চা বানাতে লেগে পড়লাম। লেবু চা, বরফ চা, কমলা চা, জলপাই চা, আমলকি চা, মরিচ চা, কী নয়! প্রতিটি সন্ধ্যায় বিভিন্ন স্বাদ পরিবারের সময়কে আরো আকর্ষণীয় এবং আন্তরিক করে তুলতো। চায়ের পাশাপাশিও মজাদার কিছু রাখতে মা ভুলতেন না। 

আমার পরিবারে সবাই ঝালপ্রিয় মানুষ। তাই, মা আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর অথচ সুস্বাদু মশলাদার খাবার রান্না করতেন। ধরুন, আলুর চপ এবং ডিমের চপ এই দুটোকে এক করে, তেলে ডুবিয়ে, কুড়মুড়ে মশলাদার করে রান্না করতেন তিনি। আমি তাদের নাম দিয়েছিলাম –‘ডিমালু চপস!’ ছোটবেলায় যখন শাকসবজি ভালো লাগতো না, তখন তিনি রোল, পাকোড়া, সমোসা, শিঙাড়া, মুগলাই পরোটা বানাতেন তবে সবই খাঁটি সবজি দিয়ে। ফুলকপির শিঙাড়া, বরবটি পাকোড়া, লাল শাকের পাকোড়া, নালতাশাকের পাকোড়া, ডাটাশাকের পাকোড়া, পালংশাকের সমোসা এবং বেগুন-টমেটো-মাংসের রোলগুলি অভিনব ফাস্ট ফুডের মতোই স্বাদযুক্ত লাগতো। আমাদের অজান্তেই আমরা অনেক সবজি খেতাম! 

শুধু ভাজা খাবারই নয়, চটপটি, ছোলাভাজা, ঘুগনিও ছিল আমাদের স্ন্যাকসের তালিকায়। মা সবসময় নজর রাখতেন স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস তৈরির দিকে, তাই চটপটি, ছোলাভাজা, ঘুগনিতে থাকতো- মটর, পেঁয়াজ, পুদিনা পাতা, ধনে পাতা, টমেটো, বরবটি, আলু, ডিম, মটরশুটি, শসা, শালগম, মূলা এবং বিভিন্ন ধরণের গরম মশলা। তবে, আমি এবং আমার বোন সবচেয়ে বেশি ভালবাসতাম সন্ধ্যায় আমড়া-মরিচ, ঝালমুড়ি কিংবা ফুচকা খাওয়া। ঠান্ডা ঋতুতে, আমরা স্ট্রিট ফুডের জন্য ব্যাকুল হয়ে যেতাম।

কিন্তু এগুলো খাওয়া আমাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। তাই, মা আমাদের জন্য বিশেষভাবে বাসাতেই এসব তৈরি করতেন। আমড়াগুলি শুকনো মরিচ বা মরিচের সসের সাথে পরিবেশন করা হতো। আর ঝালমুড়িতে থাকত বিভিন্ন ধরনের মরিচ, পেঁয়াজ, মটর, শসা, টমেটো, ঢেঁড়স এবং ধনে পাতা। ফুচকা তৈরি করা ছিল আমার বোনের কাজ। তিনি তেঁতুলের সস, ঝালমুড়ি, আলুর চাটনি, মসলা চাটনি ফুচকার সাথে পরিবেশন করতেন।

ঝাল খাবার ছাড়াও সন্ধ্যায় মিষ্টান্ন থাকতো। আমার মা মিষ্টি-প্রিয় মানুষ এবং তার তৈরি মিষ্টি খাবার রীতিমতো অমৃতের মতো। তিনি হলেন ‘হালুয়া শেফ!’ নারকেলের হালুয়া নারকেল এবং ক্যারামেল দিয়ে তৈরি করতেন, বুটের হালুয়া এবং সুজির হালুয়া বাদাম, ক্রিম, দুধের গুঁড়া, বুট বা সুজি, দারুচিনির সাথে প্রচুর মাখন দিয়ে তৈরি করতেন। গাজরের হালুয়াও আছে যা গাজরের কিমা দিয়ে তৈরি করা হতো। 

প্রায় ৯ বছর আগে, আমার বাবা যখন মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিলেন, তিনি আমাদের জন্য একটি মাখন বাদাম কুকি নিয়ে এসেছিলেন, নাম ‘ঘোরাইবি’। প্রচুর বাদাম দিয়ে তৈরি করা হয় এই উপাদেয় খাদ্যটি। যদিও আমাদের সন্ধ্যার স্ন্যাকস দেশীয় খাবারে ভরপুর ছিল, মাঝে-মাঝে আমরা ইংলিশ স্ন্যাকসও খেতাম, যেমন ক্রিমি ভ্যানিলা পুডিং, চকো পুডিং, কিমা আপেল পাই এবং ফ্রুট কাস্টার্ড। শীতল এবং মিষ্টি খাবারগুলো গরমের দিনগুলোতে বেশ স্বস্তি এনে দিতো। যখন রান্না করা শিখলাম, তখন আমি বিভিন্ন সংস্কৃতির বিভিন্ন খাবার রাঁধার চেষ্টা করতাম। এর মধ্যে একটি ছিল জাপানি খাবার ‘তাইয়াকি’। এই গরম কেকগুলি মাছের আকৃতির এবং প্যানকেকের মতো ময়দা দিয়ে তৈরি, সাথে একটি মিষ্টি লাল শিমের পেস্ট, কাস্টার্ড বা চকলেট দিয়ে একে স্টাফ করা হয়। আমার বোন এবং আমি বিভিন্নভাবে তাইয়াকির আকৃতি দিতাম। এটি প্রায় বাংলাদেশি খাবার ‘খাজা’র মতোই। খাজা ময়দা, ক্যারামেল এবং গুড়ে সমৃদ্ধ হয়। 

কোনো কোনো দিন আমরা বাসায় আলু পাতলা করে কেটে, মশলার সাথে মিশিয়ে, ডুবিয়ে তেলে ভাজা করে আলুর চিপস তৈরি করতাম। সন্ধ্যাবেলার একটি মচমচে নাস্তা। এই চিপসগুলি প্রায় দক্ষিণ আফ্রিকার প্ল্যান্টেন চিপসের মতো। গরম তেলে কাঁচা কলা ভেজে একে প্রস্তুত করা হয়, এবং আফ্রিকার সর্বত্র পাওয়া যায় এটি। আর্জেন্টিনায় একটি বিখ্যাত স্ন্যাক আছে, যার নাম ‘এমপানাডাস’। এটি তৈরির আদর্শ উপায় হল পেস্ট্রিতে গরুর মাংসে ভরে একে রাঁধা। নিরামিষাশীরা পেঁয়াজ, পালং শাক, পনির বা সিদ্ধ ডিম দিয়ে এমপানাডাস উপভোগ করেন এবং যারা মিষ্টি খাবার পছন্দ করেন তারা ফল বা মিষ্টি দিয়ে এটি খেয়ে থাকেন। এমপানাডাসের আকৃতি দেখতে প্রায় ‘নকশী পিঠা’র মত। আমরা এই পিঠাকে অনেক নামে ডাকতাম, কিন্তু খুব কমই জানতাম যে আমরা প্রায়ই আমাদের সন্ধ্যার খাবারে আর্জেন্টাইন নাস্তা খাচ্ছিলাম।       

আমার ভাইবোনরা ডায়েট বজায় রাখার বিষয়ে কঠোর ছিল। সবসময় মেনে চলতে পারতো তা নয়, তবে আচমকা তাদের মাঝে উদ্রেক জাগতো! তাই মা সন্ধ্যার খাবারে তাদের জন্য সালাদ রাখতেন। তিনি বিভিন্ন ফল এবং সবজির সালাদ তৈরি করতেন কিন্তু বিশেষভাবে আমার মনে আছে ‘রোজাক’-এর কথা। একটি আনন্দদায়ক, কুড়কুড়ে, মিষ্টি-মশলাদার মালয়েশিয়ান ফলের সালাদ। কখনও কখনও এতে শাকসবজি, টফু, কাটলফিশ বা চিংড়ি অন্তর্ভুক্ত থাকে। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমি ওয়াফেলস খুব ভালোবাসতাম এবং গরম লিকুইড চকোলেটের সাথে চকোলেট কুকিজ ছিল আমার প্রিয় সন্ধ্যার নাস্তার মধ্যে একটি।

বেশিরভাগ সময়, আমরা ওয়াফেলস এবং কুকিজ কিনতাম। ক্যারামেলের মতো সিরাপ দিয়ে ভরা নেদারল্যান্ডসের ‘স্ট্রুপওয়াফেলস’ ছিল তার মধ্যে একটি। বছরখানেক পর, আমার ভাই নরওয়েতে থাকার সময় নরওয়েজিয়ান ওয়াফেলস নিয়ে আসেন আমাদের জন্য। নরওয়েজিয়ান ওয়াফেলস আইসক্রিম, ম্যাপেল সিরাপ বা মধু দিয়ে পরিবেশন করা হয়। স্বর্গের মতো মিষ্টি তার স্বাদ! 

এছাড়াও আমরা ফ্রেন্স স্ন্যাক ‘পা ও চকোলা’ খেতাম, যা হল মাখন, চকোলেটে ভরা একটি কোয়াসো। আমার বোন বিভিন্ন সংস্কৃতির মশলাদার স্ন্যাকস তৈরিতে ভাল ছিলেন। আমার এখনও মনে পড়ে, একবার ঈদ-উল-আযহায় তিনি গরুর মাংস এবং পেঁয়াজভরা একটি অস্ট্রেলিয়ান মিট পাই তৈরি করেছিলেন। মাঝে মাঝে ব্রাজিলিয়ান স্ন্যাক ‘কক্সিনহা’-ও তৈরি করতেন। ছোট ভাজা মুরগি, পনির, ক্রোকেট, ময়দা দিয়ে তৈরি এই স্ন্যাক দেখতে অনেকটা প্রায় চিকেন ড্রামস্টিকের মতো, এবং গরম সসের সাথে একে পরিবেশন করা হয়। 

বাঁধাধরা জীবনের চক্রে আমরা প্রায় সকলেই জীবনের উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলেছি। যখন ভাল দিনগুলির দিকে ফিরে তাকাই, তখন এই পারিবারিক আনন্দ ও আড্ডাগুলোকে মন্ত্রমুগ্ধকর এবং হৃদয়গ্রাহী বলে মনে হয়। তবে এটা সত্যিই, ভালো খাবার ভালো মেজাজ তৈরী করে দেয়। আপনারও কী তাই মনে হয়?

Related Post
ফিফার জ্বর

ফিফার জ্বর

‘ফুটবল শুধু একটি খেলা নয়, এটি একটি আবেগ’- কথাটি প্রতিটি বিশ্বকাপেই সত্যি হয়। ‘ফুটবল’...

Subscribe To Our Newsletter

Subscribe To Our Newsletter

Join our mailing list to receive the latest news and updates from our team.

You have Successfully Subscribed!