বাংলাদেশে বুফের প্রবণতা

by | জানু. 3, 2023 | Feature

Traditional Khichuri hobe

বৈশ্বিক অর্থনীতির টালমাটাল এই সময়ে মানুষের ক্যারিয়ার নির্বাচনে এসেছে বৈচিত্র্যতা। বেকারত্ব ও ব্রেইনড্রেনের পরিমাণ বেড়েছে। আশার কথা হচ্ছে, ই-কমার্স ও নতুন নতুন ব্যবসায়ীক চিন্তাভাবনার ফসল হিসেবে গড়ে উঠেছে স্টার্ট-আপ, ক্লাউড কিচেন, অনলাইন শপ, ক্রিয়েটিভ মার্কেটিং, অনলাইন ব্লগিং, পার্সোনাল ব্লগিং, ডাটা সায়েন্সের মত অভিনব এবং অদ্বিতীয় সব আইডিয়া। এই ধারাবাহিকতায় পিছিয়ে নেই ঐতিহ্যবাহী ব্যবসাগুলোও। প্রথাকে ধরে রেখে আধুনিকতায় খাপ খাইয়ে নিতে তারাও বদ্ধপরিকর। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে সব থেকে অগ্রসর সেক্টরটি মনে হয় রেস্তোরাঁ।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলতে থাকা এই ব্যবসা বিভিন্নভাবে, বিভিন্নরূপে, কাস্টোমারদের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে পাল্টেছে বহুবার। তৈরী হয়েছে নানা শাখা উপশাখা। কোনটা শর্করা-প্রধান তো কোনটা আমিষ-প্রধান। হালের ভেগানিজমও বাদ পড়েনি। এই পরিবর্তনে মূল ইনফ্লুয়েন্সটি ছিলো ভোক্তা-চাহিদা। ব্যবসায়ীক উৎকর্ষতা সাধনে অন্যদের থেকে নিজেদেরকে আলাদা দেখানোর জন্য ব্যবসায়ীরাও ফেঁদেছেন নানা ফন্দি। বুফে, বাফে বা বাফেট যে যাই বলুক বাংলাদেশের ফুড সেক্টরে এই ফন্দিটির রাজত্ব চলছে বর্তমানে। ব্যাপারটি নতুন কিছু নয়, আগে বড় বড় থ্রি-স্টার, ফাইভ-স্টার রেস্তোরাঁয় এই চল থেকে থাকলেও সাধারণ জনগণের কাছে তা ছিলো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অথচ বাংলাদেশের সব থেকে বড় ভোক্তা শ্রেণিই এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। বিভিন্ন সময়ে এই শ্রেণির কাছে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে।

Every section is organized in a proper way

একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায় বাংলাদেশে শুরুটা হয়েছিলো থিমেটিক রেস্তোরাঁর মাধ্যমে। যেমন: ট্রেইন থিম, গুহা থিম, লাইব্রেরী থিম, হাসপাতাল থিম, স্পোর্টস থিম, নবাবী থিম, প্রাকৃতিক থিম, কার্ট থিম, জেল থিম ইত্যাদি। সেগুলোর জনপ্রিয়তাও একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছিলো আকাশচুম্বি। থিমেটিক রেস্তোরাঁর আইডিয়া একেবারে বিলুপ্ত হয়ে না গেলেও বেশ খানিকটা ফিঁকে হয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে পট পরিবর্তনে খাবার কেন্দ্রিকতা সামনে এলো। ইন্টেরিয়রের আলো ঝলমলে পরিবেশ থেকে বের হয়ে মানুষ খাবারের গুণগত মান, পরিমাণ, দাম ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করা শুরু করলো। এরই ধারাবহিকতায় এলো সেটমেন্যু, কম্বো অফার ইত্যাদি। ফুড ডেলিভারি সিস্টেমের কল্যানে এটি এখনও অবশ্য স্বদর্পে টিকে আছে।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির কম টাকায় ভালো কিছু, বেশি কিছু পাওয়ার আকাঙ্খা থেকেই এখনকার ট্রেন্ড হচ্ছে ‘বুফে’। রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরাও লুফে নিয়েছেন এই সুবর্ণ সুযোগটি। এত বড় একটা ভোক্তাশ্রেণির আগ্রহের কথা বিবেচনায় রেখে কম লাভে বেশি বিক্রির চিরায়ত ব্যবসায়ীক ফঁন্দিটি মাথায় রেখে তারাও অফার করছে স্বল্প টাকায় বুফে। ঝকঝকে ইন্টেরিয়র ও বিস্তৃত আসন ব্যবস্থা থাকছে সেখানে। এই ট্রেন্ডের সব থেকে বড় সেলিং পয়েন্ট হচ্ছে বিভিন্ন রকম খাবারের আধিক্য। ফলে, ক্রেতাসাধারণ তাদের ছোটখাটো পারিবারিক অনুষ্ঠান কিংবা কর্পোরেট মিটিং সেরে ফেলতে পারছেন খুব কম খরচে ও ভালো পরিবেশে। এখানে যে বিষয়টি না বললেই নয় সেটি হচ্ছে, রেস্তোরাঁর মালিকরাও রাখছেন না কোন কার্পণ্যের ছোঁয়া। ফুরিয়ে যাবার আগেই পূরণ করে দিচ্ছেন খাবারের পাত্রগুলো। যত ইচ্ছা খেয়ে পেটের সাথে সাথে ভোক্তার মনও ভরছে, রাজকীয় প্রসন্নতায় ভাসছেন পাশাপাশি খাবারও পাচ্ছেন ভ্যালু ফর মানি, আর কি চায়!

Hygiene is also one important thing in buffet

রাজধানী ঢাকাতে অভিজাত এলাকাগুলোতে মধ্যবিত্তের কথা মাথায় রেখে গড়ে ওঠা এই ধরনের রেস্তোরাঁগুলো আজ নেহায়েত কম নয়। খিলগাঁও, মিরপুর, উত্তরা, এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা ধানমন্ডিতে এ ধরনের রেস্তোরাঁর আধিক্য চোখে পড়ার মত। অবশ্য গুলশান বা বনানীতে একই টাইপের রেস্তোরাঁ থাকলেও সেগুলোর দাম একটু চড়া। দামটা শুরু হচ্ছে ৪০০ টাকা থেকে। এই রেঞ্জে সাধারণত ফুড আইটেম থাকছে ৪০ এরও বেশি। ৫৫০ টাকাতে যেখানে সুবিধা থাকে ৬০টিরও বেশি আইটেম গ্রহণ করার। এরপরের ধাপটি থাকে ৭০০ টাকার এবং সেখানে পাওয়া যায় ১০০টিরও বেশি আইটেম। আকর্ষণটাই থাকে এখানে। এত রকমের খাবার স্বাধীনভাবে খেতে পারার এই সুযোগ তাও এত কম খরচে, সবাই একবার হলেও চেখে দেখতে চাইবেন।

এবার আসা যাক খাবারের মান নিয়ে। একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা খাচ্ছেন তাদের মধ্যে খাবারের মান নিয়ে প্রায় ৮০ ভাগ লোকই সন্তস্ট। খাবার পাচ্ছেন না বা শেষ হয়ে যাচ্ছে সে অভিযোগও তুলনামূলকভাবে খুবই কম। বর , স্টার্টার, মেইন ডিশ ও ডেজার্টের প্রায় সব পদের খাবারই খেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছেন তারা, সাথে আনলিমিটেড পানীয় তো থাকছেই। খাবারের কমতিও নেই কোথাও। সেদিক দিয়ে রেস্তোরাঁগুলো অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার।

এবার কথা বলা যাক বিজনেস স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। ফুড সেক্টরে আপাত দৃষ্টিতে মুনাফা লাভ করা সহজ মনে হলেও আসলে তা নয়। কাঁচামালের প্রাপ্যতা, উৎস, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ডেকোরেশন, কর্মীদের বেতন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন ধরনের ভ্যাট ও চার্জ, মেইন্টেনেন্স ইত্যাদি দিক সামলিয়ে বিপণন প্রক্রিয়া সচল রাখা বেশ বড় একটা চ্যালেঞ্জই বটে! রেস্তোরাঁগুলো অভিজাত এলাকায় হওয়ায় তাদের ফ্লোর ভাড়া বেশি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে খরচ কমানোর জন্য পৃথিবীর সব থেকে পুরাতন রীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, স্বল্প মুনাফা বেশি বিপণন। এছাড়াও যত বেশি মানুষের খাবার একত্রে রান্না করা হবে খরচও তত কমে আসবে। এ জাতীয় বিভিন্ন রকম ব্যবসায়ীক নীতি মাথায় রেখে এই রেস্তোরাঁগুলো তাদের ব্যবসা সফলভাবে পরিচালনা করে যাচ্ছে।

বাফে ট্রেন্ডের এই চারিদিকে হিড়িক পড়া সময়ে সন্তস্ট মালিকপক্ষ ও ভোক্তা উভয়েই। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তাই শুধু উচ্চবিত্তরাই নন মধ্যবিত্তদেরও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এই বুফে ট্রেন্ড। মহামারীর এই কঠিন সময়টাকে ছাপিয়ে যেয়েও পেছনে ফিরে তাকাতে হচ্ছে না রেস্তোরাঁগুলোকে। পাশাপাশি একবারে নির্দিষ্ট একটা টাকার বিনিময়ে ভোক্তারা পূরণ করে নিচ্ছেন তাদের সখটাও। বাড়িতে দাওয়াত করে শত পদের রান্না করে মেহমানদেরকে সন্তুষ্ট করার চেয়ে একটা বাফে রেস্তোরাঁয় সিট বুক দেওয়া অধিকতর সহজ। তাই বর্তমান যুগের এই খাবারকেন্দ্রিক মুখোরতায় বাফে ট্রেন্ডের জয়জয়কার সর্বত্র।

Related Post
বিয়ে বাড়ি

বিয়ে বাড়ি

‘বিয়েবাড়ি’ কথাটা শুনলেই চোখের সামনে ঝা চকচকে উৎসবমূখর পরিবেশ ভেসে ওঠে আর কানে বাজতে থাকে...

Subscribe To Our Newsletter

Subscribe To Our Newsletter

Join our mailing list to receive the latest news and updates from our team.

You have Successfully Subscribed!